রক্তদান করলে কি উপকার হয়? রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা
প্রিয় পাঠকবৃন্দ,
আজকে আমরা রক্তদানের উপকারিতা ও অপকারিতা, রক্ত দিলে কি কি ক্ষতি
হয়, রক্ত দিলে কি ওজন বাড়ে, রক্তদান করলে কি উপকার হয় এবং রক্ত দানের
গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করবো। তবে চলুন শুরু করা যাক।
আমরা সকলে জানি যে, রক্তদান করা একটি মহৎ কাজের সমান। রক্তদান করলে যেমন
রক্তদাতার দেহের উপকার হয় ঠিক সেভাবে একজন মূমুর্ষ রোগী নতুন করে জীবন পায়।
পোস্ট সূচীপত্র: রক্তদান করলে কি উপকার হয়? রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা
রক্তদান একটি মানবিক অবদান
রক্তদান, এটি মানব সমাজের জীবনমূল্য অবশ্যই প্রয়োজন। অনেকে এটির গুরুত্ব
সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার কারণে আমরা এটির উপকারিতা অনেকটা অবাধ্য হতে দেই।
কিন্তু আসুন, এই নিষ্পেষ ধারণা মোচন করে দেখি কিভাবে রক্তদান মানব জীবনে কি
ভূমিকা রাখে।
রক্তদান কে বা কারা এবং কত বছর বয়স থেকে করতে পারবে?
রক্তদান করলে কি উপকার হয় এবং রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে
আমরা জানবো তবে এর আগে আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানা খুবই
প্রয়োজন সেটি হচ্ছে- রক্তদান কে বা কারা এবং কত বছর বয়স থেকে করতে পারবে?
সাধারণত পূর্ণবয়স্ক 18 বছর বয়সের সকল নর-নারী নিশ্চিন্তে ও নিরাপত্তার সাথে
রক্তদান করতে পাবে। রক্তদান করতে গেলে একটি মানুষকে পূর্ণাঙ্গ সুস্থ হতে
হবে এবং তিন মাস অন্তর রক্তদান করতে পারবে। এতে স্বাস্থ্যের কোনো প্রকার
ক্ষতি হবেনা বরং স্বাস্থ্যের জন্য এটি কতটুকু উপকার তা কয় জনেবা জানতে
চাই।
রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু উপকার বা রক্তদান করলে কি উপকার হয়?
মনে রাখবেন রক্তদানে কোনো সমস্যা হয় না। কেননা একজন সুস্থ মানুষের শরীরে
পাঁচ-ছয় লিটার রক্ত থাকে এবং এর মধ্যে সাধারণত ২৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত
দান করা হয়, যা শরীরে থাকা মোট রক্তের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ। রক্তের মূল
উপাদান পানি, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পূরণ হয়।
- রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য উপকার। রক্তদানের সঙ্গে-সঙ্গে শরীরের ‘বোনম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকা জন্ম হয়, ঘাটতি পূরণ হয়।
- বছরে তিনবার রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলে এবং নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়ায়।
- নিয়মিত রক্তদানকারীর হার্ট ও লিভার ভালো থাকে।
- স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে পাঁচটি পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনা খরচে করা হয়। এর মাধ্যমে জানা যায় শরীরে অন্য বড় কোনো রোগ আছে কি না। যেমন- হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) ইত্যাদি।
- রক্তদান অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার প্রতিরোধেও সহায়তা করে।
- রক্তে কোলস্টেরলের উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে।
- শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতিকে বলে Hemochromatosis। নিয়মিত রক্তদান করলে এই রোগ প্রতিরোধ করে।
- স্থূলদেহী মানুষের ওজন কমাতে রক্তদান সহায়ক।
- মুমূর্ষুকে রক্ত দিলে মানসিক তৃপ্তি মেলে।
রক্তদানের আরও কিছু উপকারিতা
- রক্তদানে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে এবং রক্তের কোলেস্টারলের মাত্রাও কমে যায়। ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি মারাত্মক রোগের আশঙ্কা হ্রাস পায়। হার্ট ভাল থাকে এবং রক্তদাতা সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকেন।
- শরীরে রক্তকণিকা তৈরির কারখানা হলো অস্থিমজ্জা। নিয়মিত রক্তদান করলে অস্থিমজ্জা থেকে নতুন কণিকা তৈরি হয়, ফলে অস্থিমজ্জা সক্রিয় থাকে। এতে যেকোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে হঠাৎ রক্তক্ষরণ হলেও শরীর খুব সহজেই তা পূরণ করতে সাহায্য করে।
- রক্তদানের সময় রক্তে নানা জীবাণুর উপস্থিতি আছে কি-না তার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। ফলে রক্তদাতা জানতে পারেন তিনি কোন সংক্রামক রোগে ভুগছেন কি-না।
- অনেক সময় রক্তদাতার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
- যাঁদের রক্তে আয়রন জমার প্রবণতা আছে, রক্তদান তাঁদের জন্য ভালো। আইরন কমাতে সহায়তা করে।
- রক্ত দেয়ার সময় রক্তের গ্রুপিং করা হয়। ফলে রক্তদাতা তার রক্তের গ্রুপ জানতে পারেন।
- সাধারণত যে সংস্থার কাছে রক্ত দেয়া হয় তারা একটি ‘ডোনার কার্ড’ তৈরি করে দেয়। এই কার্ডের মাধ্যমে একবার রক্ত দিয়েই রক্তদাতা আজীবন নিজের প্রয়োজনে ওই সংস্থা থেকে রক্ত পেতে পারেন।
- রক্তদান একটি মহৎ কাজ, যা রক্তদাতাকে মানুষ হিসেবে বড় করে তোলে। রক্তদাতার সবচেয়ে বড় পাওয়া অসহায় বিপন্ন মানুষের জীবন বাঁচানো।
- রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকে পুণ্যের বা সওয়াবের কাজ। একজন মানুষের জীবন বাঁচানো অবশ্যই মহৎ কাজ।
- মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সকল দৃষ্টিকোণ থেকেও রক্তদাতা অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন এবং সামাজিকভাবেও বিশেষ মর্যাদা পান। গ্রহীতা আর তার পরিবার চিরদিন ঋণী থাকেন তার জীবন বাঁচানোর জন্য। দাতার জন্য এটি কি যে আনন্দের তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।
তাই যেখানে নিজের ক্ষতি হবে না, বরং লাভই হবে, আর অন্য একজন মানুষের জীবনও
বাঁচবে, তাহলে আমরা স্বেচ্ছায় রক্তদানে কেন এগিয়ে আসবো না? আমাদের উচিত
আমরা স্বেচ্ছায় রক্তদানে স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসবো। আমরা সমাজে একে অন্যের ওপর
নির্ভরশীল। পারস্পরিক আদান-প্রদান আর সহায়তা সমাজবদ্ধ জীবনের অন্যতম
পূর্বশর্ত। আর স্বেচ্ছায় রক্তদান এই সেবাপরায়ণতার অনুপম উদাহরণ। রক্তদান
আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও বটে। এটা সম্পূর্ণ মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক
কার্যক্রম। এর মাধ্যমে সামাজিক প্রীতিবন্ধন মজবুত করে, সামাজিক দায়িত্ববোধ
বৃদ্ধি করে, এমনকি ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
সরকারিভাবে ও বেসরকারিভাবে যারা এই রক্ত সংগ্রহের কাজে জড়িত তারা কিছু
বিষয়ে রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতে পারেন। যেমন- তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা,
পুরস্কারের ব্যবস্থা করা বা অন্য কোনভাবে সম্মানিত করা ইত্যাদি। এতে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে রক্তদাতার সংখ্যা বেড়ে যাবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও
উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে। গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও
ধর্মীয় নেতারা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। নিরাপদ রক্তের
পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় কেবল বিনামূল্যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের
মাধ্যমে। এ জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যাতে পৃথিবীর
সব দেশে বিনামূল্যে স্বেচ্ছায় রক্তদান নিশ্চিত করার মাধ্যমে মুমূর্ষু রোগীর
জীবন নিরাপদ রক্ত দিয়ে বাঁচানো যায়। তবে মনে রাখতে হবে, রক্ত সঞ্চালন যেন
নিরাপদ হয়। আর যদি দূষিত, রোগাক্রান্ত রক্ত দেয়া হয়, তাহলে জীবন রক্ষার
পরিবর্তে অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালনে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
মনে রাখতে হবে, আমার শরীরের রক্তে আরেকটি জীবন রক্ষা করছে। পৃথিবীর আলো,
বাতাস উপভোগের অপার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তাই পরোপকারই হোক আমাদের জীবনের
ব্রত। আমাদের স্লোগান একটি হবে- “এক ফোটা রক্তের জন্য যাবেনা তো কাহার
প্রাণ, আছি মোরা রক্তযোদ্ধা, ভয় নেই তো আর, নিজের শরীরের এক ফোটা রক্ত দিয়ে
হলেও বাঁচিয়ে তুলবো একটি ঝড়ে প্রাণ”। "রক্ত দিয়ে যুদ্ধ নয়, রক্ত দিয়ে জীবন
জয়।"
রক্তদানে কিছু শর্ত সমূহ
- রক্তদাতাকে সুস্থ থাকতে হবে এবং ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৪৫ কেজি ওজনের যেকোনো মানুষ রক্তদান করতে পারে।
- দাতার রক্তের স্ক্রিনিং টেস্ট বা রক্ত নিরাপদ কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
- ভরপেটে খাওয়ার চার ঘণ্টা পর রক্ত দেওয়া শ্রেয়।
- কোনো রূপ এনার্জি ড্রিংক রক্তদানের আগে সেবন না করাই ভালো।
- যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তদান করতে পারেন।
যাঁদের রক্তদান নিষেধ রয়েছে
- ক্যান্সার, হিমোফিলিয়া, ম্যালেরিয়াসহ জীবাণুঘটিত কোনো রোগী।
- এইচআইভি বা এইডস আক্রান্তরা।
- মাদক সেবনকারী।
- হেপাটাইটিস-বি ও সি-র এন্টিজেন পজিটিভ যাঁদের। পরবর্তী সময় তা নেগেটিভ হলেও রক্ত দেওয়া যাবে না।
- গর্ভবতী মহিলারা।
- যাঁদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হয়।
- যাঁরা বারবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন।
- গত তিন মাসের মধ্যে রক্তদান করেছেন এমন মানুষ।
- যাঁদের শরীরের কোনো স্থানের গ্ল্যান্ড (লিম্ফনোড) ফুলে গেছে। বিশেষ করে ঘাড়, গলায়, হাতের নিচের গ্লান্ড।
রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা
প্রতিটি মানুষের শরীরে রক্তের প্রয়োজন হয়। আপনার বৈদ্যুতিন কাজের সময় যখন
একাউন্টের ব্যালেন্স মেটারি নেই, ঠিক তেমনি আমাদের শরীরে রক্তের মেটারি কমে
গেলে কোনো স্থিতিশীলতা থাকে না। তাই যখন আমরা অন্যের জীবনে রক্তের অভাব
পূরণ করি, তখন আমরা তাদের জীবনে একটি উজ্জ্বল প্রকাশ ফেলি।
রক্তদান করা মানবতার চিহ্ন
রক্তদান করা মানবতার একটি প্রতীক। এটি অন্যের জীবন বাঁচানোর উদাহরণ। আপনি
নিজেও দেখতে পান যে, রক্তদান করার সময় অন্যের মধ্যে আপনার সহানুভূতির
প্রকাশ নিয়ে আপনি নিজেও অনেক সন্তুষ্ট হন। এটা যেন একটি সহজ পথ যা অন্যের
দুঃখ মিটিয়ে আপনার মন খুলে দেয়।
আপনি যদি আমাদের সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ে থাকে তবে অবশ্যই আপনি একটি পরিপূর্ণ
জ্ঞান পেয়েছেন যে, রক্তদান করলে কি উপকার হয়? রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা
সম্পর্কে।
শেষাংশ
রক্তদান করলে কি উপকার হয় এবং এর উপকারিতা ও অপকারিতার শেষাংশে বলা
যায়- রক্তদান একটি মহৎ কাজ যা অন্যদের জীবন রক্ষার পাশাপাশি নিজের
শরীরেরও উপকার করে। রক্তদান করলে শরীরের অতিরিক্ত রক্ত কমে যায়, যার ফলে
নতুন রক্তকোষ তৈরি হয়, এবং শরীর সতেজ ও সজীব থাকে। এছাড়া, রক্তদান করলে
হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, কারণ রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হার্ট অ্যাটাকের
সম্ভাবনা কমে। তাছাড়া, নিয়মিত রক্তদান করলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের
ঝুঁকি হ্রাস পায়। যেসব মানুষ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তাদের জন্যও
রক্তদান সহায়ক হতে পারে, কারণ রক্তদান করলে ক্যালরি খরচ হয়। রক্তদান
মানসিকভাবে একজনকে তৃপ্তি দেয়, কারণ এর মাধ্যমে একজন মানুষ অন্যের জীবন
বাঁচাতে সহায়তা করেন।
তবে, রক্তদানের কিছু অপকারিতাও রয়েছে, বিশেষ করে যাদের শরীর দুর্বল বা
যারা কোনো রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে রক্তদান বিপজ্জনক হতে পারে।
রক্তদানের পর মাথা ঘোরা, ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভূত হতে পারে, যা সাধারণত
অল্প সময়ের জন্য হয়। এছাড়া, যদি রক্তদানের সময় সংক্রমণ হয় বা নিরাপদ উপায়ে
রক্তদান না করা হয়, তাহলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে,
সাধারণত সঠিক নিয়ম মেনে রক্তদান করলে তা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং
স্বাস্থ্যকর।
আমরা আশা করছি আপনি আমাদের পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়েছেন এবং রক্তদান
করলে কি উপকার হয়? রক্ত দানের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে অনেক
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।