ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস | কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম ও দোয়া

প্রিয় পাঠকবৃন্দ! দীর্ঘ ০১ মাস রোজা রাখার পরে আমরা পবিত্র ঈদুল ফিতরকে আমাদের মাঝে পাই আনন্দ উপভোগের জন্য এবং তার আড়াই মাস পরে আমরা আমাদের মাঝে পবিত্র ঈদুল আজহাকে পাই যা খুবই আনন্দের মূহুত্ব। এই আনন্দটিকে আমরা আরও সুন্দর করার জন্য এবং মহান আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমরা এইদিনে পশু কোরবানি করে থাকে। যা আমাদের মহান রবের নিকট খুবই পছন্দের একটি জিনিস। তাই আজকে আমরা কোরবানিকে কেন্দ্র করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করব এবং যেটি পড়ে আপনি হয়তো জানতে পারবেন কোরবানি দেওয়া আমাদের মুসলিমদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। চলুন তবে আর কথা না বাড়িয়ে এই বিষয়টি সম্পর্কে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাক।

কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম ও দোয়া

ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির ইতিহাস

দুনিয়ায় মানব বসতির শুরুতেই কোরবানির প্রচলন শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আমাদের আদি পিতা ও নবী হযরত আদম (আ.) এর ছিল দুই সন্তান। প্রথম সন্তান কাবিল ছিল আল্লাহ তায়ালা ও পিতা-মাতার অবাধ্য বা কাফের এবং কাবিলের ছোট ভাই হযরত আদম (আ.) এর দ্বিতীয় ছেলে হাবিল যে ছিল আল্লাহভীরু ও মুমিন। সে সময় আল্লাহ তায়ালার হুকুমে জোড়া জোড়া সন্তান জন্মগ্রহণ করতো। একজন পুত্র ও একজন কন্যা সন্তান। আল্লাহ তায়ালার বিধান মতো প্রথম জোড়ার পুত্রের সাথে দ্বিতীয় জোড়ার কন্যার বিয়ে বৈধ ছিল। কাবিল আল্লাহ তায়ালার বিধান মানতে রাজি ছিল না। সে চেয়েছিল তার জোড়ার সুন্দরী বোনকেই বিয়ে করবে। এই নিয়ে কাবিল হাবিলের সাথে বনিবনা হতো না এবং আল্লাহ্ পক্ষ থেকে হযরত আদম (আ.) এর উপর নির্দেশ আসে এবং তাদের দুজনকে কোরবানি পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো। আর বলা হলো যার কোরবানি কবুল করা হবে সেই প্রথম জোড়ার সুন্দরী বড় বোনকে বিয়ে করবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হচ্ছে, (হে নবী!) আপনি এদের কাছে আদমের দুই সন্তানের গল্পটি যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন; গল্পটি ছিলো, যখন তারা দুজনে আল্লাহর নামে কোরবানি পেশ করলো, এরপর আল্লাহর পক্ষতে হাবিলের কোরবানি কবুল করা হলো, আর কাবিলের কোরবানি কিছুতেই কবুল করা হলো না। সে জন্য কাবিল হাবিলকে বললো আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করবো। কাবিলের কথা শুনে হাবিল বললেন, আল্লাহ তায়ালা তো শুধু পরহেজগার লোকদের কাছ থেকেই কোরবানি কবুল করে থাকেন’ (সূরা আল মায়েদা: ৫-২৭)।

কাবিল আল্লাহ তায়ালার আইন অমান্য করার কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম হত্যাকাণ্ড ঘটায় পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান আল্লাহর দ্বীনের শত্রু, দুনিয়ায় শয়তানের প্রথম শিকার কাফের ‘কাবিল’। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম আল্লাহর আইন, বিধান বা দ্বীন অমান্য করা আর মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটালো আল্লাহর দ্বীনের শত্রু কাফের ‘কাবিল’। এটাই হচ্ছে নাস্তিক, কাফের ও শয়তানের কাজ, যা আল-কুরআনের সূরা আল মায়েদাসহ আরো কয়েকটি সূরায় উল্লেখ আছে। পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস ও হত্যার ঘটনা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।

আজকে মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দেখানো পথ বা সুন্নাত। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তাঁর সে কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল (আ.) এর কোরবানির সূত্র ধরে আজও কোরবানি প্রচলিত আছে।

হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কোরবানির সূত্রপাত: 

ইসলামের ইতিহাসে ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় ঘটনা। এটি কেবল একটি কাহিনী নয়, বরং একটি মহান ত্যাগের প্রতীক। এই প্রবন্ধে আমরা ইব্রাহিম আঃ এর কোরবানির সম্পূর্ণ ইতিহাস এবং এর শিক্ষাগুলো বিশ্লেষণ করব।

ইব্রাহিম আঃ ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)। তাঁর জীবনী এবং কর্মগুলি কোরআন এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি আল্লাহর পথে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং ত্যাগের মহান উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন।

মুসলিম মিল্লাতের বা জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদ ও তার সাঙ্গো-পাঙ্গের অত্যাচারে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হযরত সারাকে সাথে নিয়ে শাম দেশে হিজরত করলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানকার বাদশাহ ছিলো জালিম ও ভীষণ বদলোক। বাদশাহর লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর সুন্দরী স্ত্রী হযরত সারার আগমনের সংবাদ বাদশাহর দরবারে পৌঁছে দিলে। এরপর বাদশাহ তাদেরকে ধরে নিয়ে আসতে বলে। বাদশাহর লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী সারাকে বাদশাহর দরবারে হাজির করে। বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর কাছে জানতে চায় তার সাথে স্ত্রী লোকটি কে? ইব্রাহীম (আ.) চিন্তা করলেন, স্ত্রী বললে হয়তো বা তাঁকে মেরে ফেলতে পারে, তাই তিনি বলেন, সে আমার দ্বীনি বোন। বাদশাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে বন্দী করে, আর হযরত সারাকে বাদশাহর বদস্বভাব চরিতার্থ করার জন্যে রেখে দেয়। বাদশাহর কু-প্রস্তাবে হযরত সারা রাজি নাহলে বাদশাহ তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। অতঃপর হযরত সারা দু’রাকায়াত সালাত আদায় করার অনুমতি চাইলে বাদশাহ তাঁকে সালাত আদায়ের ব্যবস্থা করতে দেয়। হযরত সারা সালাত শেষে আল্লাহ দরবারে ফরিয়াদ করেন- যেন আল্লাহ তায়ালা তাঁর সতীত্ব রক্ষা করেন। এরই মধ্যে বাদশাহ অত্যন্ত অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবস্থা খারাপ দেখে আর বাদশাহর মৃত্যুর জন্য তার লোকেরা হযরত সারাকে দায়ী করবে ভেবে হযরত সারা বাদশাহর সুস্থতার জন্য দোয়া করেন। একে একে তিন বার একই ঘটনা ঘটলে বাদশাহ হযরত সারার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। হযরত সারার সতীত্ব দেখে আর এক সতী নারী হযরত হাজেরাকে তাঁর দাসী হিসেবে দিয়ে তাঁদেরকে বিদায় করে দেয়।

হযরত সারা ও হযরত ইব্রাহীম (আ.) মুক্ত হয়ে সে দেশে বসবাস শুরু করেন। হযরত সারা তাঁর দাসী হযরত হাজেরাকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সাথে বিয়ে দেন। কারণ হযরত সারার বয়স তখন ৯০ বছর আর হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর বয়স তখন ১০০ বছর। তাদের বিয়ের দীর্ঘ সময় পার হলেও তখনো হযরত সারা মা হতে পারেননি। তিনি ভাবলেন শেষ বয়সে যদি আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানি করে তাঁর স্বামী হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে কোনো সন্তান দান করেন। আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানিতে এই হযরত হাজেরার গর্ভেই হযরত ইসমাইল (আ.) এর জন্ম হয়।

হযরত ইসমাইল (আ.) এর জন্মের পর হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর স্ত্রী হযরত হাজেরা ও কলিজার টুকরা ছেলেকে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশে কাবা ঘরের নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন স্থানে সামান্য খেজুর ও এক মসক পানিসহ রেখে আসেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন তাঁদের এ অবস্থায় রেখে স্থান ত্যাগ করছিলেন, তখন হযরত হাজেরা প্রশ্ন করছিলেন, আপনি আমাদের এ নির্জন স্থানে রেখে চলে যাচ্ছেন? হযরত ইব্রাহীম (আ.) ক্ষীণকন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। আবারো হযরত হাজেরা প্রশ্ন করলেন এটা কি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ? হযরত ইব্রাহীম (আ.) আবারও জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। হযরত হাজেরা আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানে অবস্থান করলেন।

সে সময় কাবা ঘরের তেমন কোনো চিহ্ন ছিলো না। কাবা ঘরের ভিটিটি জমিন থেকে বেশ উঁচু ছিল। বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট বন্যায় চার পাশ ভেঙে গিয়েছিল। হযরত হাজেরা ও তাঁর সন্তানের খাদ্য ও পানীয় যখন শেষ হয়ে গেলো হাজেরা তখন খাদ্য ও পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। যখন নিরাশ হয়ে ফিরছিলেন তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। হাজেরা বলেন, কে আছো আমি তোমার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি সম্ভব হলে তুমি আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু সাহায্য করো। হঠাৎ তিনি তাঁর শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.) এর কাছে একজন লোক (ফেরেশতা) দেখতে পেলেন। সে (ফেরেশতা) তাঁর পায়ের গোড়ালি অথবা ডানা দ্বারা জমিনে আঘাত করলে অথবা হযরত ইসমাইল (আ.) এর কান্নাজনিত পায়ের গোড়ালির ঘর্ষণে নিচ থেকে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হতে লাগল। এ সেই ফোয়ারা বা কূপ যা বর্তমানে জমজম নামে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পরিচিত। সুপেয় পানীয় হিসেবে পান করে পরিতৃপ্ত হন মুসলমানরা। তাও কাবাকে কেন্দ্র করে ও হযরত ইসমাইল (আ.) এর উছিলায় আল্লাহ তায়ালার করুণায় সৃষ্টি হয়েছে।

হাজেরা তাঁর মসক পূর্ণ করে নিলেন আর নিজেও তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন। এতে হযরত হাজেরার ক্ষুধা নিবারণ হল ও তাঁর শিশু পুত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় দুধেরও ব্যবস্থা হলো। হযরত হাজেরার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ক্রমাগত ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার বিধান জারি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই ‘সাফা ও মারওয়া’ পাহাড় দুটো আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন সমূহের অন্যতম, অতএব, যদি তোমাদের মধ্যে কোনো লোক হজ বা ওমরা আদায় করার এরাদা করে তার জন্যে এই উভয় পাহাড়ের মাঝে তাওয়াফ করা বা দৌড়ানো দোষের কিছু নেই, কেননা যদি কোনো ব্যক্তি অন্তরে নিষ্ঠার সাথে কোনো ভালো কাজ করে তাহলে তারা যেন জেনে রাখে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা কৃতজ্ঞতাপরায়ণ ও প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী” (সূরা বাকারা-২-১৫৮)।

হযরত ইসমাইল (আ.) এর যখন হাঁটা-চলা ও খেলাধুলা করার বয়স তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে স্বপ্নে আদেশ করা হলো, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো। ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম (আ.) আবারো ১০০টি উট কোরবানি করলেন। আবারো তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছেতো এ মুহূর্তে আমার কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর তেমন কোনো প্রিয় বস্তু নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে (হযরত ইব্রাহীম আ. কে) একজন ধৈর্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করলাম। সে যখন পিতার সাথে হাঁটা-চলার উপযোগী হলো, তিনি (ইব্রাহীম আ.) বললেন, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কোরবানি করছি। সুতরাং তোমার মতামত কি? সে (হযরত ইসমাইল আ.) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আমাকে আল্লাহর মেহেরবানিতে ধৈর্যশীলদের একজন পাবেন। অতঃপর যখন তাঁরা দু’জন একমত হলো আর আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করল এবং ইব্রাহীম (আ.) ইসমাইল (আ.) কে জবাই করার জন্যে কাত করে শুইয়ে দিলো; তখন আমি ইব্রাহীমকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম, তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে রূপ দিয়েছো। নিশ্চয়ই এটা ছিল ইব্রাহীম ও ইসমাইলের জন্যে একটা পরীক্ষা। অতঃপর আমি ইব্রাহীমকে দান করলাম একটি মহা কোরবানির পশু। অনাগত মানুষের জন্যে এ (কোরবানির) বিধান চালু রেখে, তাঁর স্মরণ আমি অব্যাহত রেখে দিলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহীমের ওপর। আমি এভাবেই সৎপরায়ণ ব্যক্তিদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। (সূরা আস সফফাত-১০১-১০৯)

কোরবানি করা কি বা কোরবানি করা কি ফরজ না ওয়াজিব

কোরবানি করা ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা, যা ঈদুল আযহার সময় পালন করা হয়। এটি হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ত্যাগের স্মরণে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়।

কোরবানি কি সুন্নত নাকি ওয়াজিব? এ বিষয়ে মুজতাহিদ ফকিহদের মাঝে দু’টো মত রয়েছে।

প্রথম: সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ি, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রমুখের মত এটা। আর এর উপরই হানাফী মাজহাবের ফতোয়া। আর ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদের একটি মতেও কোরবানি ওয়াজিব। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর মতেও কোরবানি করা ওয়াজিব।

দ্বিতীয়: কোরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বা অত্যন্ত তাকিদপূর্ণ সুন্নাহ। এটা ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ, ইবনে কুদামা, ইবনে হাযম রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখসহ একদল ফকীহদের মত। আর এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম মালিকের মতেও সুন্নতে মুয়ায়াক্কাদাহ। 

কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি পরিত্যাগ করা মাকরুহ। যদি কোন জনপদের লোকেরা সামর্থ্য হওয়া সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কোরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কোরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার বা বৃহৎ নিদর্শন। (আহকামুল উদহিয়্যাহ, পৃ.২১৪ )

কোরবানি কাদের উপর ওয়াজিব

কোরবানি মূলত তাদের উপর ওয়াজিব যাদের উপর কিছু নির্দিষ্ট শর্ত প্রযোজ্য। এই শর্তগুলো হলো:

  • যার সম্পদ বা ধন-সম্পদ নির্দিষ্ট পরিমাণের উপরে আছে (নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা) এবং যে প্রয়োজনীয় খরচাদি বাদ দিয়ে এই সম্পদ রেখে দিতে পারে, তার উপর কোরবানি ওয়াজিব।
  • কোরবানি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।
  • প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে।
  • মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে।
  • বাসস্থানস্থায়ী হতে হবে, মুসাফিরদের উপর কোরবানি ওয়াজিব নয়।
  • এই শর্তগুলো পূরণ করা ব্যক্তিদের উপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
আরও সহজ ভাষায় যদি বলা হয় তবে, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কের প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।

কোরবানির পশু কেমন হতে হবে

কোরবানির পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত আছে যা পালন করা অত্যন্ত জরুরি। গরু, মহিষ অন্তত দুই বছর ও উট অন্তত ৫ বছর হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে ছয় মাসেরটি দেখতে এক বছরের মতো লাগে, তাহলে সেটি দিয়ে কোরবানি হবে। এমন দুর্বল পশু কেনা যাবে না যার হাড়ের মজ্জা শুকিয়ে গেছে বা কোরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবে না। এরকম পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। 

বিস্তারিতভাবে বললে কোরবানির পশু কেমন হতে হবে তা নিচে বর্ণনা করা হলো:

কোরবানির জন্য পশু অবশ্যই হতে হবে হালাল এবং শারীরিকভাবে সুস্থ। পশুটির বয়সও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত, গরু এবং মহিষের ক্ষেত্রে বয়স দুই বছর পূর্ণ হতে হবে এবং ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে এক বছর পূর্ণ হতে হবে। তবে ভেড়ার ক্ষেত্রে যদি ছয় মাস পূর্ণ হয় এবং দেখতে এক বছরের মতো হয়, তবুও তা গ্রহণযোগ্য।

কোরবানির পশুর শারীরিক অবস্থা ভালো হতে হবে। এটি চোখে, কান বা শরীরে কোনো গুরুতর ত্রুটি থাকা উচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, খুবই রোগাক্রান্ত, লেজ বা কান কাটা, অন্ধ, অথবা পা ভাঙা পশু কোরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

অতএব, কোরবানির পশু নির্বাচনের সময় এই শর্তগুলো অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে, যাতে কোরবানি সহীহ এবং গ্রহণযোগ্য হয়।

গরু জবাই করার সময় মাথা কোন দিকে থাকবে

গরু জবাই করার সময় ইসলামী বিধান অনুসারে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা উচিত। গরু জবাই করার সময় তার মাথা কিবলার দিকে রাখা উচিত। কিবলা হচ্ছে মক্কার পবিত্র কাবা শরীফের দিকে মুখ করে থাকা। 

গরুর মাথা কিবলার দিকে রাখা ইসলামী শিষ্টাচারের অংশ এবং এটি আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি। এছাড়া, জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবর বলে আল্লাহর নামে জবাই করা উচিত। এটি নিশ্চিত করে যে, জবাইকৃত পশুটি হালাল এবং ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী।

এই নিয়ম মেনে চললে কোরবানির কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় এবং তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম ও কোরবানির গরু জবাই করার দোয়া আরবি

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর নিজের কোরবানির পশু তাঁর নিজ হাতে জবাই করেছেন। যার যার কোরবানির পশু তাদের নিজ হাতে জবাই করার কথাও এসেছে হাদিসে। কোরবানির পশু জবাইয়ের রয়েছে নিয়ম-পদ্ধতি ও দোয়া।

অধিকাংশ মানুষ কোরবানি নিয়ম-পদ্ধতি ও দোয়া না জানার কারণেই নিজের কোরবানি নিজেরা করেন না। অথচ কোরবানির নিয়ম-পদ্ধতি ও দোয়া সহজ। তবে পশু জবাইয়ের সময় সুন্নাতের অনুসরণে জবাই করাই উত্তম। কোরবানি করার সময় যে বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন-

১. পশু জবেহ করার সময়: বিসমিল্লাহ' বলে জবেহ করা। অর্থাৎ বিসমিল্লাহ বলেই ছুরি চালানো শুরু করা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যেন পশু জবেহ করা না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা।

২. পশু জবেহ করার জন্য ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নিতে হবে। যাতে জবেহ করার সময় পশুর কষ্ট না হয়। হাদিসে এসেছে-
'রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'পশু জবেহ করার আগে ছুরি-চাকুতে ভালোভাবে ধার দিয়ে নেয়া।' (মুসলিম)

৩. কোরবানি করার সময় পশুকে পশুর বাম কাতে শোয়ানো। সে সময় পশুর পাগুলো পশ্চিম দিকে থাকবে।

৪. পশু জবেহ করার সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী আর দুই পাশে থাকা দুটি নালী কেটে দেয়া। এ নালীগুলে কাটা হয়ে গেলেই পশু জবেহ বিশুদ্ধ হয়ে যায়।

৫. পশু জবাইয়ের দোয়া
কোরবানির পশু জবেহ করার জন্য শোয়ানোর পর দোয়া পড়া। দোয়াটি হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। যদিও অনেকে দোয়াটির সনদের ব্যাপারে মতপার্থক্য করেছেন। তবে এ দোয়াগুলো পড়ে কোরবানি করা উত্তম। তবে কেউ শুধু বিসমিল্লাহ বলে নালীগুলো কেটে দিলেই কোরবানি শুদ্ধ হয়ে যাবে। দোয়াটি হলো- "ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা আলা মিল্লাতি ইবরাহিমা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি-জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।"

৬. যদি কেউ এ দোয়াটি না পারেন তবে ছোট্ট এ অংশটুকু পড়বেন- "বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা।"

৭. নিজের পশু নিজে কোরবানি করলে পশু জবেহ করার পর এ দোয়া পড়া- "আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিম।"

৮. অন্য কেউ কোরবানি বা অন্য কারো কোরবানি করলে এ দোয়া পড়া- "আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিনকা-মিনকুম’ কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিম।"

কোরবানির গোসত বন্টনের সঠিক নিয়ম

কোরবানির গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজেরা খেতেন, একভাগ যাকে চাইতেন তাকে খাওয়াতেন এবং একভাগ ফকির-মিসকিনকে দিতেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কোরবানির মাংস আত্মীয় ও গরিবদের মাঝে বিতরণ না করাটা খুবই গর্হিত কাজ। এতে কৃপণতা প্রকাশ পায়। কারণ কোরবানির মাধ্যমে কোরবানিদাতা অহংকার থেকে নিরাপদ থাকেন এবং তার অন্তর পরিশুদ্ধ থাকে।

২০২৪ সালের কোরবানির ঈদ কত তারিখে

এবার আসি ২০২৪ ইং সালের পবিত্র কোরবানির ঈদ কত তারিখে হবে- সৌদি আরবের চাঁদ দেখা কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী এবার (২০২৪ সালে) ১০ জিলহজ বা কোরবানির ঈদ হতে পারে জুন মাসের ১৬ তারিখ।

বাংলাদেশে সাধারণত সৌদি আরব, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত এইসব দেশের পরের দিন কোরবানির ঈদ পালন করা হয়। সেই হিসেবে বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ পালিত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে জুন মাসের ১৭ তারিখ। তবে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে তারিখ পরিবর্তন হতে পারে।

পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দ আমরা ভাগাভাগি করে নেই সকলের মাঝে, হিংসা-বিদ্বেষ সব ভেঙ্গে এক হই সকলে পবিত্র এই দ্বীনে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url