মাতৃদুগ্ধের বা মায়ের পরিণত দুধের উপকারিতা

প্রিয় পাঠক,

আজকে আমরা জানবো মাতৃদুগ্ধের বা মায়ের পরিণত দুধের উপকারিতা সম্পর্কে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এটি। চলুন তবে শুরু করা যাক এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক যা আমাদের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মাতৃদুগ্ধের বা মায়ের পরিণত দুধের উপকারিতা

মাতৃদুগ্ধের বা মায়ের পরিণত দুধের উপকারিতা

শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর উপকারিতা বা পুষ্টিগত সুবিধাগুলি হল:-

১. মায়ের দুধে শর্করা, প্রোটিন এবং স্নেহপদার্থ যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। তা ছাড়া, প্রতি 10 ml মায়ের দুধের শক্তির পরিমাণ 67 থেকে 71 kcal| মায়ের দুধে ল্যাকট্যালবুমিন থাকায় তা গোরুর দুধের তুলনায় সহজে পাচিত ও শোষিত হতে পারে। অন্যদিকে গোরুর দুধে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি (3.3g%) হওয়ায় তা সহজে হজম হয় না।
 
২. মায়ের দুধ সহজে শিশুকে দেওয়া যায়। শিশুরা চাহিদামতো মায়ের দুধ পান করে থাকে। গোদুগ্ধ বা অন্যান্য দুগ্ধের তুলনায় এটি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ। কারণ, এই দুধ মায়ের দেহ থেকে সরাসরি সন্তানের পৌষ্টিকতন্ত্রে গৃহীত হয়। 

৩. স্বাভাবিক অবস্থায় মাঝারি স্বাস্থ্যের স্তন্যদাত্রী মা প্রতিদিন 400 থেকে 600 ml শিশুকে দিতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষরণের পরিমাণ কমবেশি হয়।
 
৪. মায়ের দুধ শিশুকে শৈশবকালীন মেদবহুলতা থেকে রক্ষা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুকে গোরুর দুধ পান করালে তাতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকায় শিশু শৈশবেই মোটা হতে শুরু করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে মেদ বৃদ্ধির কারণে মধুমেহ দেখা দেয় । 

৫. মায়ের দুধ শিশুর দেহে ক্যালশিয়াম এবং ফসফরাসের সঠিক মাত্রা বজায় রাখতে সহায়তা করে। মায়ের দুধের।

জেনে রাখুন

  • শিশুর ওজন প্রতি সপ্তাহে গড়ে 120g বৃদ্ধি পায়।
  • রাত্রি ১১ টা থেকে ভোর ৫ টা পর্যন্ত দুধ পান করানোর প্রয়োজন হয় না ।
  • শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা ও শিশুকে প্রায় ৬ ঘণ্টা বিশ্রাম দেওয়া উচিত।
  • শিশুর দৈনিক 600ml দুধের প্রয়োজন।

মাতৃদুগ্ধের পুষ্টিগত মূল্য (Nutritive value of breast milk)

পশুর দুধ অপেক্ষা মাতৃদুগ্ধে জলের ভাগ বেশি হওয়ায় তা শিশুর পক্ষে হজম করা সহজ হয়।
খাদ্যের ৬টি উপাদানই মাতৃদুগ্ধে বর্তমান, যা শিশুর দেহের পক্ষে উপযুক্ত।

শর্করা, প্রোটিন ও স্নেহপদার্থ

১. শর্করা: মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত ল্যাকটোজজাতীয় শর্করা ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম ও অ্যামিনো অ্যাসিড শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ল্যাকটোজ পাচিত হয়ে গ্যালাকটোজ উৎপন্ন করে যা স্নায়ু কোশের মায়েলিন পর্দা গঠনে সহায়তা করে। মায়ের দুধে অ্যামাইলেজ নামক শর্করা পরিপাককারী উৎসেচক বর্তমান।

২. প্রোটিন : মাতৃদুগ্ধে ল্যাকট্যালবুমিন নামক প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন সহজে পাচিত হয়ে শিশুর দেহে শোষিত হয়। ল্যাকট্যালবুমিনে উপস্থিত অ্যামিনো অ্যাসিড শিশুর দেহগঠনে অংশ নেয় এবং শিশুর দেহে অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিডের চাহিদা পূরণ করে। মাতৃদুগ্ধে সিসটিন, মিথিওনিন এবং টরিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। টরিন একটি সালফারযুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড। এটি শিশুর কেন্দ্রীয় নার্ভতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে। মাতৃদুগ্ধে প্রোটিন ভঙ্গক এনজাইমও থাকে। ওই এনজাইম প্রোটিনকে বিশ্লেষণ করে পেপটোনে পরিবর্তিত করতে পারে। গোরুর দুধে উপস্থিত প্রোটিন ভঙ্গকারী উৎসেচক দুধ গরম করা (Pasteurization)-এর সময় নষ্ট হয়ে যায়।
 
৩. স্নেহপদার্থ : মাতৃদুগ্ধে প্রচুর পরিমাণে স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট থাকে। এই ফ্যাটই শিশুর শক্তিচাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে। মাতৃদুগ্ধের ফ্যাটে কোলেস্টেরলসহ অন্যান্য অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড বর্তমান। মায়ের দুধে উপস্থিত ফ্যাটের।

৪. শতাংশই হল ট্রাইগ্লিসারাইড। ট্রাইগ্লিসারাইড শিশুর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে। এতে উপস্থিত লাইপেজ নামক উৎসেচক ফ্যাটকে বিশ্লেষণ করে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে পরিণত করে। ফলে মাতৃদুগ্ধের ফ্যাট খুব সহজে শিশুদেহে পাচিত হতে পারে।

ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও জল 

১. ভিটামিন: মাতৃদুগ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন A, C, E এবং ভিটামিন B কমপ্লেক্স থাকে। শিশু সরাসরি মায়ের দেহ থেকে দুধ পান করে বলে, এই দুধকে আলাদাভাবে গরম করার প্রয়োজন হয় না। ফলে অধিক উত্তাপে ভিটামিন B এবং ভিটামিন C-এর অপচয় হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না । মায়ের দুধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি শিশুর দেহে ফোলিক অ্যাসিডের শোষণ বৃদ্ধি করে।

২. খনিজ পদার্থ: মাতৃদুগ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালশিয়াম এবং ফসফেট থাকে। প্রতি 100 ml দুধে ক্যালশিয়াম ও ফসফরাসের পরিমাণ যথাক্রমে 33 mg I 15 mg| এ ছাড়া মাতৃদুগ্ধে খুব অল্প পরিমাণ লোহা ও তামা থাকে। এই দুটি খনিজ পদার্থ শিশুর দেহে ভালোভাবে শোষিত হতে পারে। মাতৃদুগ্ধের আর—একটি বৈশিষ্ট্য হল—এটি জিংক—এর শোষণ বৃদ্ধি করে।

৩. জল: মায়ের দুধে 44% জল থাকায়, তা শিশুর পৌষ্টিকতন্ত্রের পক্ষে সহজপাচ্য। এ ছাড়াও জলের পরিমাণ বেশি হওয়ায় গরমকালে শিশুকে জল না খাওয়ালেও চলে। ফলে, জলবাহিত বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা পায়।

মাতৃদুগ্ধের সুফল (Benefits of breast milk)

মাতৃদুগ্ধ মা ও শিশু উভয়কেই দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক সুফল দান করে । 

অনাক্রম্যতাজনিত সুফল

১. মাতৃদুগ্ধে উপস্থিত রোগপ্রতিরোধকারী উপাদানগুলি হল- লাইসোজাইম, ল্যাকটোফেরিন, ম্যাক্রোফাজ, লিম্ফোসাইট, ইমিউনোগ্লোবিউলিন A এবং অল্প পরিমাণ ইমিউনোগ্লোবিউলিন M। এগুলি শিশুর দেহে অনাক্রম্যতা গড়ে তোলে।

২. লাইসোজাইম উৎসেচক দুধে উপস্থিত পারক্সাইড ও ভিটামিন দ্বারা নিষ্ক্রিয় ব্যাকটেরিয়ার কোশপ্রাচীরকে আক্রমণ করে। দুধে উপস্থিত ল্যাকটোপারক্সিডেজ স্ট্রেপটোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে।

৩. ল্যাকটোফেরিন উপাদানটি পেটের অসুখ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি অন্ত্রে ই. কোলাই, স্ট্রেপটোকক্কাস প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি প্রতিহত করে।

৪. মাতৃদুগ্ধের অন্যান্য।

উদ্ভিদ খাদ্যে অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডের ঘাটতি থাকে। চাল ও গমে অপর্যাপ্ত লাইমিন থাকে, তবে মেথিওনিন  পর্যাপ্ত থাকে। ভালে লাইমিন পর্যাপ্ত থাকে তবে মেথিওনিন কম থাকে। তাই চাল ডালের মিশ্রণে উভয় খাদ্যেল অপর্যাপ্ত  এ্যামাইনো এসিড .,....  পূরণ করে প্রোটিনের পুষ্টি মান উন্নত হয়। উদ্ভিদ খাদ্যের সাথে কিছু প্রাণিজ খাদ্য মেশালেও প্রোটিনের পরিমাণ বাড়ে। যেমন, দুধ, রুটি, দুধ ভাত, দুধ মুজি ইত্যাদি। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রতিকিলো গ্রাম Body Weight এর জন্য ০.৮ বা ১
গ্রাম প্রোটিন দরকার।

এ হিসেবে-
৫৫ কেজি ওজনের একজন পুরুষের জন্য দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা: ৫৫*০.৮= ৪৪ গ্রাম
৪৫ কেজি ওজনের একজন মহিলার দৈনিক প্রোটিনের চাহিদা-
৪৫*০.৮ গ্রাম
= ৩৬.০ গ্রাম
শিশুদের দৈনিক বৃদ্ধির হার বেশী বলে শিশুদের জন্য প্রথম ৬ মাসে প্রতি কেজি ওজনে ২৫-২.২ গ্রাম প্রোটিন লাগবে।

বয়স ও ওজন অনুপাতে শক্তির ও প্রোটিনের চাহিদার তালিকা:-

বয়স
দেহের ওজন
kg
শক্তি পরিমাণ
kcal
প্রোটিনের পরিমাণ
(২-৬) মাস
(3.3-7.8) kg
118 kcal
2.0g
(৬-১২) মাস
(4-10) kg
108 kcal
1.7g
(১-৩) বছর
12.9 kg
1220 kcal
16.7g
(৪-৬) বছর
18 kg
1820 kcal
20.1g
(৭-৯) বছর
25 kg
1690 kcal
29.5g
বালক: ১০-১২
বালিকা: ১০-১২
34.3 kg
35 kg
2190 kcal
2010 kcal
54.3g
51.9g
বালক: ১৩-১৫
বালিকা: ১৩-১৫
47.6 kg
46.6 kg
2750 kcal
2330 kcal
54.3g
51.9g
বালক:১৬-১৭
বালিকা:১৬-১৭
55.4 kg
52.1 kg
3020 kcal
2440 kcal
61.5g
55.5
কিশোর: ১৬-১৭
কিশোরী: ১৬-১৭
55.4 kg
55 kg
 
61.5g
55.5g
পুরুষ:
নারী:
60 kg
55 kg
 
60g
55g
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url