সরকারি চাকুরীতে কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি ২০২৪

সরকারি চাকুরীতে কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে এবং যা খুবই দ্রুত গতিতে করা হয়েছে। আর আজকে আমাদের আলোচনা মূল বিষয়টিই হচ্ছে কোটা এবং বিস্তারিতভাবে জানবো কতটুকু কোটা কোথায় গিয়ে যোগ-বিয়োগ করা হয়েছে।
কোটা সংক্রান্ত সরকারি নীতিমালা ২০২৪
বর্তমান বাংলাদেশে সরকারি চাকুরীতে সকল গ্রেডে কোটা বাতিল করে কেবলমাত্র “অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ” রেখে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবি জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা এবং আপনাদের জানিয়ে রাখি যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এতে বিজয়ী হয়েছে। তাঁরা তাঁদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে জয়ী হয়েছে।

পোস্ট সূচীপত্র: সরকারি চাকুরীতে কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি ২০২৪

কোটা কী?

কোটা বলতে কোনো কিছুর নির্দিষ্ট একটি অংশকে বোঝায় যা সাধারণত একটি গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকে। মূলত সমাজের পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর মানুষগুলোকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে পড়াশোনা, চাকুরীসহ নানা ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই কোটা পদ্ধতি চালু আছে।

ব্রিটিশ শাসন আমলে সরকারি চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের জন্য কোটা ব্যবস্থা সর্বপ্রথম চালু ছিল। পরবর্তী সময়ে পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যও কোটা বরাদ্দ করা হয়। দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলেও প্রদেশভিত্তিক কোটা বরাদ্দ ছিল।

কোটা কেন দেওয়া হয়?

কোটা মূলত তারাই পায় যাঁরা কাজ করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে এবং বলা হয় তাঁরা যাতে সমাজের অন্য মানুষ হতে পিছিয়ে না পড়ে, সমাজের মানুষগুলো সাথে হাতে হাত রেখে পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারে এবং সমাজের যে কাজকর্ম হচ্ছে সেখানে অংশ নিতে পারে তাঁর জন্য কোটা দেওয়া হয়।

স্বাধীনতার আগে বা পরে কোটা ব্যবস্থা ছিল কি?

আমাদের দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭২ সালে এবং তবে থেকে আমাদের দেশে কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়।

১৯৭২ সাল থেকেই চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা ও নারী কোটার ব্যবস্থা ছিল। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কর্পোরেশন ও দপ্তরে নিয়োগোর বিষয়ে ১৯৭২ সালের পাঁচই সেপ্টেম্বর তৎকালীন সরকার একটি নির্বাহী আদেশ এই কোটা ব্যবস্থার পরিপত্র জারি করেন এবং এতে এসব প্রতিষ্ঠানে ১ম শ্রেণির চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ মেধা এবং বাকি ৮০ শতাংশ জেলা কোটা রাখা হয়। এই ৮০ শতাংশ জেলা কোটার মধ্য থেকেই ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধা এবং ১০ শতাংশ কোটা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অর্থাৎ কোটার বড় একটি অংশই বরাদ্দ করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

এরপর ০৪ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়। পরিবর্তিত জারিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো হয় এবং শুধু নারীদের জন্য আলাদা করে কোটার ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ মোট কোটার ৪০ শতাংশ মেধা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী এবং বাকি ১০ শতাংশ কেবলই জেলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় এবং কোটায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেই সাথে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে ১৯৮৫ সালে কোটা পদ্ধতির সংশোধন আনে তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়)।

সংশোধন পরিপত্রে বলা হয়, “১ম ও ২য় শ্রেণির পদসমূহের জন্য মেধাভিত্তিক কোটা হবে ৪৫ শতাংশ এবং জেলাভিত্তিক কোটা হইবে ৫৫ শতাংশ। এই জেলাভিত্তিক কোটার মধ্য হতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ, মহিলাদের ১০ শতাংশ এবং উপ-জাতীয়দের জন্য ০৫ শতাংশ পদ সমন্বয় করতে হবে।”

এভাবে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের কোটায় সংস্কার করা হয় এবং আপনারা হয়তো বা জানেন যে, সর্বশেষ কোটা বাতিলের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনের পর একটি পরিপত্র জারি করে সরকারি, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল- চাকরিতে সব ধরনের কোটায় নিয়োগ বাতিল করে সরকার। তবে ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার কয়েকজন সন্তান রিট করলে হাইকোর্ট শুনানির পর এই বছরের ৫ই জুন সরকারের ওই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে।

২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধী– এই পাঁচ ক্যাটাগরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা এবং সাধারণ শিক্ষার্থী অর্থাৎ মেধার ভিত্তিতে ৪৪ শতাংশ কোটা ছিল। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে চালু হওয়া প্রথম কোটা ব্যবস্থায় এই পরিমাণ ছিল আরও বেশি।

সর্বশেষ সংস্কারকৃত বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা

২০২৪ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা পুনরায় কোটা সংস্কারে জোর দাবি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি চালু করা মাত্রই পুরো দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জেগে উঠে এবং কোটা সংস্কার দাবিতে তাঁরা মাঠে নেমে পড়ে আর যা নিয়ে শুরু হয় পুরো দেশে এক অপ্রীতিকর অবস্থা। যা সম্পর্কে আপনারা সকলে হয়তো বা অবগত রয়েছেন।

এরপর ২০১৮ সালের হাইকোর্টের কোটা ব্যবস্থা পরিবত্রটি বাতিল করে নতুন করে ২০২৪ সালের ২১শে জুলাই সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ নতুন করে রায় প্রদান করে এবং রায় অনুযায়ী সরকারি চাকুরীর কোটা ব্যবস্থা পুনর্বিন্যস্ত করে একই মাসের ২৩শে জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার, যাতে সকল গ্রেডের নিয়োগে কোটা থাকছে মোট ৭ শতাংশ এবং বাকি ৯৩ শতাংশ হচ্ছে মেধার ভিত্তিতে।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সমতার নীতি ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রজাতন্ত্রের কর্মে প্রতিনিধিত্ব লাভ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, অর্থাৎ সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল গ্রেডে নিম্নরূপভাবে কোটা নির্ধারণ করা হল।

  • মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ।
  • মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ।
  • ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ।
  • শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্যপদ সাধারণ মেধা তালিকা থেকে পূরণ হবে।
কোটা সংক্রান্ত সরকারি নীতিমালা ২০২৪

কোটা নিয়ে এর আগে জারি করা সকল প্রজ্ঞাপন, পরিপত্র, আদেশ, নির্দেশ, অনুশাসন রহিত করা হয়েছে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার বিকালে গুলশানে এক ব্রিফিংয়ে কোটা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির কথা জানান।

এই প্রজ্ঞাপন জারির প্রেক্ষাপট, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং সরকারের অবস্থান তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমরা আমাদের কথা রেখেছি, এই প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।”

এর আগে আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে দেওয়া পরিপত্রে ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকুরীতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার। তবে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির (১৩তম থেকে ২০তম গ্রেড) গ্রেডে ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। কিন্তু এক রিট মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে গত জুন মাসে ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে কোটা ফিরিয়ে আনার রায় দেয়।

পরে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুই শিক্ষার্থীর করা আপিল শুনানি করে রবিবার হাইকোর্টের রায় বাতিল করে কোটার নতুন বিন্যাস ঠিক করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যা আমরা বলে এসেছি।

উক্ত রায়ে বলা হয়, “এই নির্দেশনা ও আদেশ প্রদান স্বত্তেও সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় এই আদালত কর্তৃক নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।”

এর দু'দিন পর সরকার আদালতের রায় মেনে কোটার নতুন বিন্যাস প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করল।

উপসংহার

কোটার মূল বিষয়টি হয়তো আপনার ইতমধ্যে জেনে গেছেন। কোটা হচ্ছে এমন একটি জিনিস যা সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কোটার বিনিময়ে তাঁদের সাধারণ মানুষদের সাথে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়। তবে সময়ের ব্যবধানে এই কোটা প্রথাটি পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়ে এসেছে। অনেকবার এটি সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু আগে যখন এটি ছিল তখন মেধার গুরুত্ব তেমন করা হয়নি। তাই সমাজে মেধাবীরা আজ পেছিয়ে পড়ে রয়েছে। তবে বর্তমান ছাত্র সমাজ জেগে উঠার কারণে কোটাকে কমিয়ে এনে এবং এটি সংস্কারের মাধ্যমে মেধাকে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। যা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য খুবই কল্যাণ জনক এবং এতে দেশ ও জাতির অনেক অগ্রগতি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছে।

“কোটায় নয় বরং মেধায় হোক যোগ্যতা যাচাই” 
এটি হোক সকলের স্লোগান।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url