থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

প্রিয় পাঠক! আজকে আমরা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করব যেটি হলো থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার। সাধারণত থ্যালাসেমিয়া শব্দটির শোনা অনেকের কাছে অপরিচিত হতে পারে, কিন্তু এটি একটি জনপ্রিয় রোগের নাম, যা আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যানসারও নয়। চলুন তবে এই রোগটি সম্পর্কে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যাক।

থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

থ্যালাসেমিয়া একটি জনপ্রিয় রক্তরোগ যা আমাদের দেশে খুবই সাধারণভাবে দেখা যায়। এটি আমাদের রক্তে হেমোগ্লোবিন উৎপাদনে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং সমতল হেমোগ্লোবিনের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই, এই লেখায় আমরা থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

থ্যালাসেমিয়া কি?

থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজি: Thalassemia) একটি অটোজোমাল মিউট্যান্ট প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা “অ্যানিমিয়া” তে ভুগে থাকেন।

থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মকণ্ঠ রোগ যা রক্তের হেমোগ্লোবিন সংক্রান্ত হয়। এই রোগে রক্তের হেমোগ্লোবিন তৈরি করতে যে খনির জীবাণুগুলি দায়ী তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। ফলে স্বাভাবিক মাত্রায় হেমোগ্লোবিন প্রস্তুত হয় না, যা রক্তের অধিক কণিকা নির্মাণের কার্যকলাপে অস্বাভাবিক প্রভাব ফেলে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর বৃদ্ধি সাধারণত অধিক হেমোগ্লোবিন নির্মাণে প্রচুর ইনফারন্ট থাকে, যা তাদের হাড়, দাঁত, হাত-পা ইত্যাদি অংশের রক্ত উৎপাদনের অভাব উদ্ভাবন করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগটি কেন হয়?

পিতা ও মাতা দু’জনই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মানবদেহে ২৩ জোড়া বা ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। প্রতি জোড়ার অর্ধেক পিতার আর বাকি অর্ধেক মাতার নিকট থেকে আসে। ১৬ নম্বর ক্রোমোজোমে থাকে আলফা জিন আর ১১ নম্বর ক্রোমোজোমে থাকে বিটা জিন। আলফা ও বিটা জিনদ্বয় আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামের প্রোটিন তৈরি করে, যা অনেক অ্যামিনো অ্যাসিডের সমষ্টি। জন্মগতভাবে ১৬ অথবা ১১ নম্বর ক্রোমোজোমের আলফা অথবা বিটা জিন সঠিকভাবে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করতে না পারলে আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন নামের প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা অথবা বিটা গ্লোবিন চেইন ত্রুটিপূর্ণ থাকলে হিমোগ্লোবিনেও ত্রুটিপূর্ণ হয়। স্বাভাবিক মানুষের লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু ১২০ দিন হলেও ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগীর লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু মাত্র ২০-৬০ দিন। অপরিপক্ব অবস্থায় লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যায়, তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, কিংবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জিন থাকলে ভূমিষ্ট শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।

থ্যালাসেমিয়ার মূল কারণ হল হেমোগ্লোবিন নির্মাণে সাহায্য করা কোনও জীবাণুর অভাব, যা জন্মগ্রহণের সময় হামার নির্মাণ করা হয়। কিছু ক্ষুদ্র উপাদান যা হেমোগ্লোবিন তৈরি করে সাহায্য করে, সেগুলির অভাবে থ্যালাসেমিয়া হতে পারে।

থ্যালাসেমিয়ার প্রকার:

থ্যালাসেমিয়া বিভিন্ন প্রকারে হতে পারে, তবে প্রধানত দুই প্রকার হলো- 

১. থ্যালাসেমিয়া মেজর
২. থ্যালাসেমিয়া মিনর। 

থ্যালাসেমিয়া মেজর আবার দুটি প্রকারে পাওয়া যায়- 

১. থ্যালাসেমিয়া মেজর বেটা 
২. থ্যালাসেমিয়া মেজর আলফা।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ কি কি এবং উপসর্গগুলো কি কি?

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি নিম্ন লেখা হলো:

  • ক্লান্তি
  • দুর্বলতা
  • ভঙ্গুর হার
  • খিদে না হওয়া
  • ফ্যাকাশে অথবা হলুদ ত্বক
  • জন্ডিস
  • গাঢ় প্রস্রাব
  • শিশুর বিলম্ব বৃদ্ধি
  • হৃদপিন্ডের সমস্যা
  • অতিরিক্ত আয়রন
  • সংক্রমণ,
  • অস্বাভাবিক অস্থি বৃদ্ধি,
  • প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া (স্প্লিনোমেগালি),
  • অবসাদ অনুভব,
  • বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,
  • শ্বাসকষ্ট,
  • মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া,
  • অস্বস্তি,
  • ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস),
  • হাড়ের বিকৃতি(প্রধানত করোটি এবং মুখমণ্ডল),
  • ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি,
  • পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া,
  • হৃৎপিণ্ডে সমস্যা
অস্বাভাবিক প্রতিধ্বনি: অনেক সময় একটি লোহিত রঙের প্রতিধ্বনি মিলতে পারে, যা সাধারণ হার্টবিট থেকে আলাদা।

প্রাথমিক প্রতিধ্বনির উন্নতি: বাচ্চাদের জন্য, ক্ষুদ্র বয়সে বাড়ানো প্রাথমিক প্রতিধ্বনির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া যায়।

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে করণীয়:

  • দু’জন বাহকের মাঝে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করা। একজন সুস্থ মানুষ যে কাউকে (বাহক বা রোগীকে) বিয়ে করতে পারবে। কারণ, তাঁদের সন্তানের এই রোগীটি হওয়ার আশঙ্কা নেই বললে চলে। তবে একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ, এতে সন্তানের এই রোগীটি হওয়ার ঝুঁকি আছে।
  • পরিবারের থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য জেনে নিন সাধারণ হিসাবে যে ব্যক্তিগণ অবস্থান করে বা থাকতে পারে।
  • সচেতন হন থ্যালাসেমিয়া সার্চডার্ফের মধ্যে যোগাযোগ হওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।
  • জরুরী ক্ষেত্রে জেনে নিন নিকটবর্তী চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী সুযোগ ও সুবিধা।
  • অবস্থার অনুযায়ী আবশ্যক চিকিৎসা ও যোগাযোগের সাথে থাকা।
  • নিয়মিত ডাক্টারের পরামর্শ নিন এবং নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরিক্ষা করানো যেতে পারে।
  • পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পরিবর্তন করে নিন এবং সহিংসতার মাত্রা নির্ধারণ করুন।
  • থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য সমাধান খুঁজে নিন, যেমন প্রয়োজনে ট্রান্সফিউশন বা অন্যান্য চিকিৎসার পদ্ধতি।
থ্যালাসেমিয়ার প্রতিকার হতে পারে নিয়ন্ত্রণে রাখা, চিকিৎসা বা প্রতিষেধক সহায়তা, বা যে কোনও প্রয়োজনীয় চিকিৎসায় অংশগ্রহণ করা।

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস:

থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতিবছর ৮ই মে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। বাংলাদেশে এই দিবসটি পালিত হয় উক্ত তারিখে। বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক সংখ্যা প্রায় ২৫০ মিলিয়ন। বিশ্বে প্রতি বছর ১ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের ১০-১২ ভাগ মানুষ এই রোগের বাহক। অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষ তাঁদের অজান্তে এই রোগের বাহক। দেশে কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু-কিশোর রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ৭-১০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

আমরা আশা করছি আমাদের পোস্টটি পড়ে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো পেয়েছেন এবং থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url