সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম

সাজনা পাতা যা আমাদের জন্য খুবই উপকারি। আমরা আজকের পোস্টটি সাজিয়েছি সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম নিয়ে। তবে চলুন আলোচনা করা যাক।

সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা

পোস্ট সূচীপত্র: সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম

সাজনা পাতার পরিচিত

সাজনা একটি অতি পরিচিত দামি এবং সুস্বাদু সবজি। সাজনার ইংরেজি নাম Drumstick এবং বৈজ্ঞানিক নাম Moringa Oleifera উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ হলেও এ গাছ শীত প্রধান দেশ ব্যতিত সারা পৃথিবীতেই জন্মে। বারোমাসি সাজনার জাত প্রায় সারা বছরই বার বার ফলন দেয়। গাছে সব সময় ফুল, কচি পড দেখা যায়। আমাদের দেশে ২-৩ প্রকার সাজনা পাওয়া যায়। বসতবাড়ির জন্য সাজনা একটি আদর্শ সবজি গাছ। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, সাজনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে।

দেশি-বিদেশি পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সাজনাকে অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ বা অলৌকিক বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ আছে যা বহু উদ্ভিদেই নেই। সাজনা সবজির চেয়ে এর পাতার উপকার আরও বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এ গাছকে মায়েদের ‘উত্তম বন্ধু’ এবং পুষ্টির এক অনন্য সহজলভ্য উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সাজনার পুষ্টিগুণ 

বিজ্ঞানীরা পুষ্টির দিক দিয়ে সাজনাকে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ আখ্যায়িত করে বলেন এ গাছটি থেকে পুষ্টি, ঔষধিগুণ ও সারা বছর ফলন পাওয়া যায় বিধায় বাড়ির আঙিনায় এটি একটি ‘মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ’ এর পুষ্টিগুণ খাদ্যোপযোগী।
  • প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্য শক্তি কিলোক্যাল ৪৩, 
  • পানি ৮৫.২ গ্রাম, 
  • আমিষ ২.৯ (গ্রাম), 
  • চর্বি ০.২ (গ্রাম), 
  • শর্করা ৫.১ (গ্রাম), 
  • খাদ্য আঁশ ৪.৮ (গ্রাম), 
  • ক্যালসিয়াম ২৪ (মি. গ্রাম), 
  • আয়রন ০.২ (মি. গ্রাম), 
  • জিংক ০.১৬ (মি. গ্রাম), 
  • ভিটা-এ ২৬ (মি. গ্রাম), 
  • ভিটা-বি১ ০.০৪ (মি. গ্রাম), 
  • ভিটা-বি২ (মি. গ্রাম) ০.০৪ ভিটামিন-সি ৬৯.৯ (মি. গ্রাম)
(সূত্র বারটান/২০১৬)

সাজনা পাতার পুষ্টিগুণ ও ব্যবহার 

বিজ্ঞানীরা মনে করেন সাজনার পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। নিরামিষভোগীরা সাজনার পাতা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারেন। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সাজনা পাতায় কমলা লেবুর ৭ গুণ ভিটামিন-সি, দুধের ৪ গুণ ক্যালসিয়াম এবং দুই গুণ আমিষ, গাজরের ৪ গুণ ভিটামিন-এ, কলার ৩ গুণ পটাশিয়াম বিদ্যমান। বিজ্ঞানীরা আরও বলেন, সাজনা পাতায় ৪২% আমিষ, ১২৫% ক্যালসিয়াম, ৬১% ম্যাগনোসিয়াম, ৪১% পটাশিয়াম, ৭১% লৌহ, ২৭২% ভিটামিন-এ এবং ২২% ভিটামিন-সি সহ দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে।

এক টেবিল চামচ শুকনা সাজনা পাতার গুঁড়া থেকে ১-২ বছর বয়সী শিশুদের অত্যবশ্যকীয় ১৪% আমিষ, ৪০% ক্যালসিয়াম ও ২৩% লৌহ ও ভিটামিন-এ সরবরাহ হয়ে থাকে। দৈনিক ৬ চামচ সাজনা পাতার গুঁড়া একটি গর্ভবর্তী বা স্তন্যদাত্রী মায়ের চাহিদার সবটুকু ক্যালসিয়াম ও আয়রন সরবরাহ করতে সক্ষম। তাই বলায় যায় যে, সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা আমাদের দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার

সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতার শেষ নেই। তবে চলুন আমরা আরো বেশ-কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা ও এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নেয়।

  • সাজনার তেল: সাজনার শুকানো বীজ ভাঙিয়ে ৩৮-৪০% ভোজ্যতেল পাওয়া যায় যাতে উচ্চ মাত্রার বিহ্যানিক এসিড থাকে যা বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক। এ তেলের কোনো গন্ধ নাই এবং অন্য যে কোনো ভোজ্যতেলের মতোই মান সম্পন্ন। তেল নিষ্কাশনের পর প্রাপ্ত খইল সার হিসেবে এবং পানি শোধনের কাজেও ব্যবহার হয়।
  • সাজনার ঔষধি গুণাগুণ: ভারতীয় আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, সাজনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে। সাজনার কচি পড সবজি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। সাজনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ঔষধিগুণ আছে।
  • শরীর ব্যথা: শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা হলে বা ফুলে গেলে সাজনার শিকড়ের প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা সেরে যায়।
  • কান ব্যাথা: সাজনার শিকড়ের রস কানে দিলে কানের ব্যথা সেরে যায়।
  • মাথা ব্যাথা: সাজনার আঠা দুধের সাথে খেলে মাথা ব্যথা সেরে যায়। আঠা কপালে মালিশ করলে মাথা ব্যথা সেরে যায়।
  • ফোঁড়া সারায়: সাজনার আঠার প্রলেপ দিলে ফোঁড়া সেরে যায়।
  • মূত্রপাথরি ও হাঁপানি: সাজনা ফুলের রস দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে মূত্রপাথরি দূর হয়। ফুলের রস হাঁপানি রোগের বিশেষ উপকারী।
  • গ্যাস থেকে রক্ষা: সাজনা পাতার রসের সাথে লবণ মিশিয়ে খেতে দিলে বাচ্চাদের পেট জমা গ্যাস দূর হয়।
  • কুকুরের কামড়ে: সাজনা পাতা পেষণ করে তাতে রসুন, হলুদ, লবণ ও গোলমরিচ মিশিয়ে সেবন করলে কুকুরের বিষ ধ্বংস হয়।
  • জ্বর ও সর্দি: পাতার শাক খেলে যন্ত্রণাধায়ক জ্বর ও সর্দি দূর হয়।
  • বহুমূত্র রোগ: সাজনা পাতার রসে বহুমূত্র রোগ সারে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য ও দৃষ্টিশক্তি: সাজনার ফুল কোষ্ঠকাঠিন্য দোষ দূর করে এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে।
  • কামশক্তি: সাজনা ফুল দুধের সাথে রান্না করে নিয়মিত খেলে কামশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। এর চাটনি হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।
  • গেঁটে বাত: সাজনার ফল নিয়মিত রান্না করে খেলে গেঁটে বাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
  • ক্রিমিনাশক ও টিটেনাস: সাজনার কচি ফল ক্রিমিনাশক, লিভার ও প্লীহাদোষ নিবারক, প্যারালাইসিস ও টিটেনাস রোগে হিতকর।
  • অবশতা-সায়াটিকা: সাজনার বীজের তেল মালিশ করলে বিভিন্ন বাত বেদনা, অবসতা, সায়াটিকা, বোধহীনতা ও চর্মরোগ দূর হয়। 

সাজনা গাছের পাতা যে-সকল রোগ সারাতে সহায়তা করে

  • রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়।
  • পোকার কামড়ে এন্টিসেপ্টিক হিসেবে সাজনার রস ব্যবহার করা হয়।
  • ক্ষতস্থান সারার জন্য সাজনা পাতার পেস্ট উপকারী।
  • সাজনা শরীরের প্রতিরোধক ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য, ভারি ধাতু অপসারণ এবং শরীরে রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি নিতে সহায়তা করে।
  • ইন্টেস্টাইন ও প্রোস্টেট সংক্রমণ: সাজনা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে।
  • শ্বাসকষ্ঠ, মাথা ধরা, মাইগ্রেন, আর্থাইটিস এবং চুলপড়া রোগের চিকিৎসায় ও সাজনা কার্যকর ভূমিকা রাখে।

সাজনার সঠিক ব্যবহার ও নিয়ম

সাজনা খাবার টেবিলে সবজি হিসেবেই বেশি ব্যবহার হয়। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাজনা বাজারে প্রচুর পাওয়া যায়। এ সময় খরিপ সবজির মধ্যে সাজনার যথেষ্ট কদর থাকে। আগাম সাজনা বাজারে নিতে পারলে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হওয়া যায়। সাজনা দিয়ে ডাল তরকারিটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। সাজনা শুধু ফল হিসেবেই নয় সাজনার কচি পাতা ও ডাঁটা বা ডাল ভাজি বা তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। পালংশাকের বিকল্প হিসেবে সাজনা শাক খাওয়া হয়। মুরগির মাংস রান্নায় কচি সাজনা পাতা সুস্বাদু লাগে। কালিজিরা, কাঁচামরিচ, রসুনের সাথে সাজনা পাতার ভর্তা একটি মজাদার খাবার। ছোট মাছের সাথে সাজনা পাতার চর্চড়ি খুবই উপাদেয়। সাজনা পাতার বড়া, সালাদ, পাতা বাটা ও সাজনা পাতার পাউডার দ্বারা খাদ্য সুস্বাদু ও শক্তি বর্ধক হয়। যে কোনো স্যুপের সাথে শুকনা সাজনা পাতার পাউডার মিশালে খাদ্যমান বেড়ে যায়। চা বা কফি তৈরিতে সাজনা পাতার পাউডার ব্যবহার করা যায়।
 
সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবেনা। তবে এটির যেমন উপকারিতা রয়েছে ঠিক তেমনটি এটি যদি আমরা অধিক পরিমাণে গ্রহণ করি তবে এর অপকারিতা আমরা বুঝতে পারবো। তাই এটি সঠিক পরিমাণে আমরা গ্রহণ করবো এবং বিশেষ প্রয়োজনে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ চিকিৎসকের নিকট পরামর্শ নিবো।
সাজনা থেকে তৈরি কয়েকটি বিশেষ খাবারের রেসিপি

সাজনা থেকে তৈরি কয়েকটি বিশেষ খাবারের রেসিপি

আমরা এযাবৎ সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানলাম। তবে চলুন এবার জেনে আসি আমরা রান্নায় কিভাবে এটিকে আমাদের খাবারের সাথে যুক্ত করতে পারি।

  • মসুর ডালে সাজনা: প্রথমে মসুর ডাল-১ কাপ, সাজনা- ১ কাপ, পেঁয়াজ কুচি, তেল, হলুদ গুঁড়া, রসুন কুচি, মেথি, সরষে বাটা, লবণ, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা পরিমাণমতো নিতে হবে। মসুর ডাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর হাঁড়িতে পানি চাপিয়ে তাতে মসুর ডাল, রসুন কুচি, হলুদ গুঁড়া দিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে। অন্য পাত্রে তেল দিয়ে সাজনা ভেজে তাতে মেথি দিয়ে তুলে নিয়ে পেঁয়াজ কুচি বাদামি করে ভেজে তেলসহ ডালে ঢেলে দিতে হবে। কাঁচামরিচ কালি ও ধনেপাতা দিয়ে চুলা থেকে নামাতে হবে।
  • সাজনা লাউ নিরামিষ: সাজনা ২৫০ গ্রাম, লাউ- আধা কেজি, শুকনা শিমের বীচি-২ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ কুচি, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, টমেটো-১টি, কাঁচামরিচ-২টি, ধনেপাতা পরিমাণমতো নিতে হবে। সাজনার আঁশ ফেলে ১.৫-২ ইঞ্চি করে টুকরা করে নিতে হবে। একই সাথে টমেটো ও লাউ টুকরো করতে হবে। শুকনো শিমের বীচি তাওয়ায় ভেজে পাটায় ভেঙে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। তেলে পেঁয়াজ অল্প ভেজে রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, সাজনা ও লাউ দিয়ে রান্না করতে হবে। শিমের বীচি দিয়ে ১০ মিনিট ঢেকে রাখতে হবে এরপর টমেটো দিতে হবে। লাউ ও সাজনা সেদ্ধ হলে, মরিচ ফালি ও ধনেপাতা কুচি দিয়ে ২-৩ মিনিট পর চুলা হতে নামাতে হবে।
  • সাজনা পাতার পাকোড়া: সাজনা পাতা-১০০ গ্রাম, মসুর ডাল-২০০ গ্রাম, পেঁয়াজ ও আলু-২০০ গ্রাম করে, কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, লবণ ও তেল পরিমাণমতো। মসুর ডাল পরিষ্কার করে ১ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সাজনা ডাঁটা ভালো করে ধুয়ে কুচি, কুচি করে কাটাতে হবে। আলু, পেয়াজ, ধনেপতা, কাঁচামরিচ, সব কুচি করে কেটে নিতে হবে। মসুরের ডাল হালকা করে বেটে নিতে হবে। ডালের সাথে কুচানো সাজনা পাতা, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও ধনেপাতা ভালো করে মেশাতে হবে। চুলায় কড়াই বসিয়ে তেল গরম করতে হবে। হাত দিয়ে গোল করে বড়ার মতো করে বানিয়ে তা গরম তেলে ভালোভাবে ভেজে নিতে হবে। সস্ বা চাটনিসহ গরম গরম পাকোড়া পরিবেশন করতে হবে।
  • আলু সাজনার তরকারি: সাজনা-৫০০ গ্রাম, আলু, পেঁয়াজ কুচি, রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া ও কাঁচামরিচ পরিমাণমতো নিতে হবে। সাজনা ডাঁটার আঁশ ফেলে ২ ইঞ্চি লম্ব করে কেটে নিতে হবে। আলুর খোসা ছিলে লম্বাকরে টুকরা করে কেটে নিতে হবে। তেলে রসুন বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লবণ দিয়ে সরষে বাটা, আলু, সাজনা দিয়ে চুলায় চড়াতে হবে। পরে পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সবজি সেদ্ধ হয়ে গেলে ধনেপাতা কুচি দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
  • সাজনা দিয়ে ইলিশ মাছ: ইলিশ মাছ-৪ টুকরা, সাজনা ৪-৫টি, বড় পেঁয়াজ কুচি-১টি কাঁচামরিচ, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া, জিরা বাটা, তেল ও লবণ পরিমাণ মতো নিতে হবে। ইলিশ মাছের টুকরাগুলো ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। সাজনাগুলো ১.৫-২ ইঞ্চি করে কেটে নিতে হবে। কড়াইতে তেল গরম হলে পেঁয়াজ কুচি ও সব মসলা, লবণ কড়াইতে দিয়ে সাজনা দিতে হবে। সাজনা দিয়ে অল্প কষিয়ে নিতে হবে। কষানো হলে তাতে মাছ দিতে হবে। তারপর অল্প নাড়াচড়া করে পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ঝোল মাখা মাখা হলে নামানোর আগে কাঁচামরিচ দিয়ে নামাতে হবে।
  • চিংড়ি নারিকেলে সাজনা মালাইকারি: সাজনা ২৫০ গ্রাম, চিংড়ি-১৫/২০টি (মাঝারি আকৃতির), নারিকেল বাটা-আধা কাপ, চিনি-১ চা চামচ, কাঁচামরিচ-২/৩টি, পরিমাণমতো পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, তেজপাতা, তেল, হলুদ গুঁড়া নিতে হবে। প্রথমে চিংড়ির মাথা ও ভেতরের কালো রগ ফেলে ধুয়ে সাজনার আঁশ ফেলে টুকরো করে রাখতে হবে। নারিকেল বেটে নিতে হবে। তেল গরম হলে তেজপাতা, পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, আস্ত চিংড়ি দিয়ে নেড়ে চেড়ে সাজনা ভেজে নিতে হবে। পানি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এরপর বাটা নারিকেল, সামান্য চিনি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ২০ মিনিট রান্নার পর নামানোর পূর্বে কাঁচামরিচ দিয়ে নামাতে হবে।
  • আম সাজনার ঝোল: সাজনা ভাটা-২৫০ গ্রাম, কাঁচা আম-৬-৭ টুকরা, পেঁয়াজ বাটা, পাঁচ ফোড়ন, রসুন বাটা, কাঁচামরিচ, সরিষার তেল, হলুদ গুঁড়া ও লবণ পরিমাণমতো। প্রথম সাজনা ডাঁটার আঁশ ফেলে টুকরা করতে হবে। কাঁচা আমের ওপরের সবুজ ত্বক ফেলে লম্বা করে কাটতে হবে। কাঁচামরিচ বেটে নিতে হবে। তেল গরম হলে পেঁয়াজ বাটা, পাঁচ ফোড়ন বাটা, হলুদ ও রসুন বাটা দিয়ে কষাতে হবে। এরপর সাজনা ডাঁটা ও লবণ দিয়ে ২ কাপ পানি দিয়ে অল্প আঁচে ঢেকে দিতে হবে। সাজনা সেদ্ধ হলে আমের টুকরা ও মরিচ বাটা দিয়ে জ্বাল দিতে হয়। তেল ওপরে ভেসে উঠলে নামিয়ে ফেলতে হব।
  • দই সাজনা: সাজনা-৫০০ গ্রাম টকদই-২০০ গ্রাম, রসুন আদা, কাঁচামরিচ বাটা, হলুদ গুঁড়া ও তেজপাতা পরিমাণমতো নিতে হবে। সাজনা ডাঁটার আঁশ ফেলে ১.৫ ইঞ্চি করে টুকরা করে নিতে হবে। তেলে তেজপাতা ভেজে পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা, হলুদ গুঁড়া ও লবণ দিয়ে কষিয়ে সাজনা ঢেলে দিতে হবে। ভালোভাবে নেড়ে টক দই দিয়ে অল্প পানি সহযোগে ২০ মিনিট পর নামাতে হবে। সাজনা পাতার সবুজ ভাত : চাল-৪০০ গাম, মুগডাল-২০০ গ্রাম, সাজনা পাতা-২০০ গ্রাম, সেদ্ধ ডিম-৩টি, টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, তেজপাতা, গরম মসলা, লবণ, সয়াবিন তেল, লেবু পরিমাণমতো নিতে হবে। প্রথমে চাল ও ডাল ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সাজনা পাতা ধুয়ে পরিষ্কার করে কেটে কুচি কুচি করতে হবে। পেঁয়াজ ও ধনেপাতা কুঁচি করতে হবে। সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে টমেটো ও শসার সাথে মিক্স করতে হবে। আদা, রসুন ও কাঁচামরিচ বেটে নিতে হবে। চুলায় কড়াই চাপিয়ে তেল গরম হলে পেঁয়াজ ভাজতে হবে। এরপর চাল ও ডাল ২ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। তারপর আদা, রসুন, কাঁচামরিচ বাটা ও তেজপাতা দিয়ে ভালোভাবে মিশাতে হবে। তারপর সাজনা পাতা যোগ করতে হবে। পরিমাণমতো পানি দিয়ে ২০ মিনিট জ্বাল দিলে সব সেদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে যাবে। কুচানো ধনেপাতা ও গরম মসলা দিয়ে নেড়ে দিতে হবে। ডিম, টমেটো, শসা ও লেবু দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
  • সাজনা পাতার সবুজ রুটি : গমের আটা-৫০ গ্রাম, বেসন-২০ গ্রাম, সাজনা পাতা-২৫ গ্রাম, পেঁয়াজ-২৫ গ্রাম এর সাথে আদা জিরা, কাঁচামরিচ, তেল, লবণ পরিমাণমতো নিতে হবে। প্রথমে সাজনা পাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে বেটে নিতে হবে। আদা, পেঁয়াজ কুচি করে কেটে নিতে হবে। জিরা ভেজে গুঁড়া করে নিতে হবে। এবার আটার সাথে বেসন ভালো করে মেশাতে হবে। একে একে মিশ্রণের সাথে সাজনা পাতা, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা ও অন্যান্য মসলা মিশাতে হবে। এরপর পানি দিয়ে রুটি তৈরির খামির বানাতে হবে। কিছুক্ষণ খামির রেখে দিয়ে রুটির গোলা তৈরি করে রুটি বেলে নিতে হবে। চুলায় তাওয়া গরম করে সাধারণ রুটির মতো সবুজ রুটি ভেজে নিতে হবে।
  • পেলকা: সাজনা পাতার তৈরি দিনাজপুরের গ্রামীণ সমাজের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও উপাদেয় খাবারের নাম হচ্ছে পেলকা। পরিমাণমতো সাজনা পাতা, খাবার সোডা এক চিমটি, রসুন ১টি কাঁচামরিচ ও লবণ স্বাদমতো নিতে হবে। ডেকচিতে ২-৩ লিটার পানি চাপিয়ে পরিমাণমতো লবণ দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। সাজনা পাতা পরিষ্কারভাবে ধুয়ে কুচি কুচি করে কেটে নিতে হবে। চুলায় পানি ফুটলে পাতাগুলো ফুটন্ত পানিতে ঢেলে দিতে হবে। এরপর আদা, রসুন কাঁচামরিচ ও সামান্য পরিমাণ খাবার সোডা দিয়ে নেড়ে নিতে হবে। পাতিলের তলায় যেন না লাগে সেজন্য চামচ দিয়ে নাড়তে হবে। মিশ্রণটি ঘন হয়ে এলে নামিয়ে পরিবেশন করতে হবে।

সাজনা পাতার গুণাগুণ

প্রতি গ্রাম সাজনা পাতায় একটি কমলার চেয়ে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও দুই গুণ বেশি প্রোটিন, গাজরের চেয়ে চার গুণ বেশি ভিটামিন এ এবং কলার চেয়ে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম বিদ্যমান। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা সহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতি জনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

  • এতে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে এবং পালংশাকের চেয়ে তিন গুণ বেশি আয়রণ বিদ্যমান, যা এ্যানেমিয়া দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
  • সাজনা শরীরে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও অন্যতম অবদান রাখে।
  • মানুষের শরীরের প্রায় ২০% প্রোটিন যার গাঠনিক একক হলো এমাইনো এসিড। শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মেটাবোলিজম এবং অন্যান্য শারীরবৃত্ত্বীয় কার্যাবলী পরিপূর্ণরূপে সম্পাদনে এমাইনো এসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের শরীরের যে ৯ টি এমাইনো এসিড খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়, তার সবগুলোই এই মরিঙ্গার মধ্যে বিদ্যমান।
  • এটি শরীরে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের মত কঠিন রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে।
  • নিয়মিত দৈনিক সেবন শরীরের ডিফেন্স মেকানিজমকে আরো শক্তিশালী করে এবং ‘ইমিউনিটি স্টিমুল্যান্ট’ হওয়ার দরুন এটি ‘এইডস’ আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
  • এটি শরীরের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পুষ্টিবর্ধক হিসেবে কাজ করে।
  • শরীরের ওজন কমাতেও ব্যায়ামের পাশাপাশি এটি বেশ কার্যকরী ভুমিকা পালন করে থাকে।
  • এটি মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। পাতা থেকে তৈরি এক টেবিল চামচ পাউডারে ১৪% প্রোটিন, ৪০% ক্যালসিয়াম, ২৩% আয়রণ বিদ্যমান, যা ১ থেকে তিন বছরের শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় এবং বুকের দুধ খাওয়ানোকালীন সময়ে ৬ টেবিল চামচ পাউডার একজন মায়ের প্রতিদিনের আয়রণ এবং ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করে থাকে।
  • এটির এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এটি যকৃত ও কিডনী সুস্থ্য রাখতে এবং রূপের সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবেও কাজ করে থাকে।
  • সাজনা-তে প্রায় ৯০টিরও বেশি এবং ৪৬ রকমের এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান।
  • এতে ৩৬ টির মত এন্টি-ইনফ্ল্যামমেটরি বৈশিষ্ট্য আছে। এছাড়াও এটি অকাল বার্ধক্যজনিত সমস্যা দূর করে এবং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

প্রতিক্রিয়া: ডঃ লয়েল ফিউগিল এর মতে, দৈনিক এই পাতা গ্রহণে কোন ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নেই।

সাজনা গাছের পুষ্টিমান, ঔষধিগুণ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার অনুশীলন করে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আরও ব্যাপকভাবে সাজনার ফল, টাটকা ও শুকনা পাতা ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত। সারা বছর এ সবজি খাওয়ার অভ্যাস বাড়ানো উচিত। তাই এর চাষ পদ্ধতি ও গুণাগুণ মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশের জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য সব পুষ্টিবিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কৃষিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, শিক্ষক ও আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এতেই সাজনা গাছের নামকরণ অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ হিসেবে সার্থকতা পাবে।

অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে সাজনা পাতার ব্যবহার

সাজনা পাতা রুমিনেন্ট জাতীয় প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় যার মাঝারি মানের রুচিকরতা বিদ্যমান। পোল্ট্রি, শূকর, খোরগোশ এবং মাছের জন্য খাদ্য হিসেবে এই পাতা ও বীজের ব্যবহার বেশ কার্যকর।

শেষাংশ

সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা অনেকগুলি রয়েছে যা আমরা উপরে আলোচনা করেছি। সাজনা পাতা হলো একটি পুষ্টিকর ও বিশেষ প্রকার শাকসবজি, যা অনেক ধরনের রোগ প্রতিরোধ করে। এটি ভিটামিন, খনিজ, ও প্রোটিনের ভালো উৎস। সাজনা পাতার মাধ্যমে চোখের ক্ষতি দূর করা যায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এর প্রতি অন্যান্য প্রকার শাকসবজির চেয়ে কম ক্যালরি ও বেশি পুষ্টি থাকে। সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম হল, এটি পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে এবং পরিমিত পরিমাণে সেবন করতে হবে। এটি ভালোভাবে পরিস্কার করে এবং কাটার পর সামগ্রিকভাবে ব্যবহার করা উচিত।

আমরা আশা করছি আপনি আমাদের পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়েছেন এবং সাজনা পাতা খাওয়ার উপকারিতা এবং সাজনা পাতা খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
 
আমাদের মূল লক্ষ্য হলো আপনাদের মাঝে সঠিক তথ্যগুলোকে উপস্থাপন করা এবং পৌঁছে দেওয়া এবং এতে আপনাদের সহযোগীতা আমরা একান্তভাবে কাম্য করছি। লেখাটি আপনাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আরো অন্যান্যদের নিকট শেয়ার করে তাদেরও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানার সুযোগ করে দিন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url