মুসলিম
শাসন বাংলায় কিভাবে শুরু হলো তা জানলে ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়ের প্রতি
আমাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। মুসলিম শাসনের সূচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের
প্রতিনিধিত্ব করে, যা বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর
গভীর প্রভাব ফেলেছে। আজকের পোস্টে আমরা দশটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন কে? সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন তবে জানা যাক।
পোস্ট সূচীপত্র: বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন কে?
মুসলিম শাসনের পূর্ববর্তী পরিস্থিতি
বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা কিভাবে ঘটেছিল তা বুঝতে হলে, প্রথমে আমাদের
জানতে হবে মুসলিম শাসনের পূর্ববর্তী পরিস্থিতি কেমন ছিল। এই সময়ে, বাংলায়
ছিলেন বিভিন্ন হিন্দু রাজা এবং তাদের রাজ্য ছিল ছোট ছোট অংশে বিভক্ত। প্রতিটি
রাজা তার নিজস্ব অঞ্চলে শাসন করতেন এবং এদের মধ্যে বারবার যুদ্ধবিগ্রহ লেগে
থাকত। মুসলিম শাসনের আগের সময়ে, বাংলার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক
অস্থিরতা ছিল স্পষ্ট।
প্রথম মুসলিম শাসক: কুতুবউদ্দিন আইবক
কুতুবউদ্দিন আইবক ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক, যিনি ১২০৬ সাল থেকে ১২১০
সাল পর্যন্ত দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সুলতান হিসেবে শাসন
করেন। তিনি গাজনভিদদের সেনাপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং পরে তাঁর দক্ষতা ও
সাহসিকতার কারণে সম্রাট আলাউদ্দিন মদিনীর কাছে সুলতান মনোনীত হন। তাঁর
শাসনামলে তিনি দিল্লিতে শক্তিশালী এক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলিম
শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁর শাসনকালে বিভিন্ন সামরিক
অভিযান পরিচালনা করেন এবং দিল্লি, কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে বহু মসজিদ এবং
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কুতুব মিনার এখনও ভারতের ইতিহাস ও
স্থাপত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। কুতুবউদ্দিন
আইবকের শাসনকাল ভারতীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল এবং মুসলিম
শাসনের ভিত্তি স্থাপনে তাঁর অবদান অমোঘ।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি এবং তার ভূমিকা
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি ছিলেন একজন তুর্কি সেনাপতি এবং
দিল্লি সালতানাতের প্রথম মুসলিম বিজেতাদের মধ্যে একজন। তিনি ১২০৪ সালে বাংলার
নদীয়া রাজ্যের উপর আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করেন, যা পরবর্তীতে বাংলার ইতিহাসে
উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে সেনাবাহিনী খুবই কমসংখ্যক
ছিল, কিন্তু তাদের যুদ্ধকৌশল ও চমৎকার ঘোড়সওয়ারীর কারণে তারা অত্যন্ত সফল
হন। তার বিজয়ের ফলে বঙ্গদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু হয় এবং দিল্লি
সালতানাতের অধীনে বাংলা প্রদেশের প্রতিষ্ঠা হয়। বখতিয়ার খলজির শাসনকালে
তিনি বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, যা
অঞ্চলের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার সময়ে বাংলায় তুর্কি
স্থাপত্যশৈলী ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধি পায়। তার নেতৃত্ব এবং বাংলার
ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তার বিজয় এবং শাসনকাল বাংলা ভাষা ও
সাহিত্যেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
মুসলিম শাসনের সূচনা এবং তার প্রভাব
মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে ৭১১ সালে যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু উপত্যকা জয়
করেন। এর পরবর্তীতে দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে, যা
ভারতবর্ষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে বিশাল পরিবর্তন আনে।
মুসলিম শাসকরা শিক্ষার প্রসার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং স্থাপত্যকলার উন্নয়নে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা উর্দু ভাষার বিকাশে ভূমিকা রাখেন এবং
হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ধারার সূচনা করেন।
মুসলিম শাসকরা আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে,
যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। ইসলামের শিক্ষা, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান চর্চার
প্রচার মুসলিম শাসনের অন্যতম প্রধান প্রভাব ছিল। মুসলিম শাসনের সময় বিভিন্ন
স্থাপত্যকলার নিদর্শন যেমন তাজমহল, কুতুব মিনার, এবং লাল কেল্লা নির্মাণ করা
হয়, যা আজও বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মুসলিম শাসনের প্রভাব ভারতীয়
উপমহাদেশে আজও বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে, যা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলার মুসলিম শাসনের বিস্তার
বাংলার মুসলিম শাসনের বিস্তার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৩০০
শতকের শুরুতে, বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর তা দ্রুত বিস্তার লাভ করতে
থাকে। সুলতান ঘিয়াসউদ্দিন, ফিরুজ শাহ ও আলাউদ্দিন হাসান শাহের শাসনকালে
বাংলার মুসলিম শাসনের প্রসার ঘটে। এই সময়ে বাংলায় মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ
ঘটে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে, এবং নতুন প্রশাসনিক ও সামাজিক
কাঠামো গড়ে ওঠে। মুঘল আমলে, সম্রাট আকবরের অধীনে বাংলার মুসলিম শাসন ব্যাপক
উন্নতি লাভ করে, কৃষি, বাণিজ্য এবং স্থাপত্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি
সাধিত হয়। বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মুসলিম শাসনের
প্রভাব আরো গভীর ও ব্যাপক হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সুদৃঢ় করে। বাংলার মুসলিম শাসনের ইতিহাস আজও আমাদের
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অমূল্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়।
মুসলিম প্রশাসনিক কাঠামো
মুসলিম শাসকদের প্রশাসনিক কাঠামো ছিল সু-সংগঠিত এবং শক্তিশালী, যা ভারতবর্ষে
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। প্রশাসন মূলত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরে
বিভক্ত ছিল। কেন্দ্রীয় স্তরে, সম্রাট ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী, যার অধীনে
বিভিন্ন মন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কাজ করতেন। প্রধানমন্ত্রী বা
‘বাজির’ প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি সাম্রাজ্যের সামগ্রিক
প্রশাসন পরিচালনা করতেন। প্রদেশগুলিতে, ‘সুবেদার’ বা গভর্নররা নিযুক্ত
থাকতেন, যারা প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা এবং শাসন পরিচালনা করতেন। কর সংগ্রহের জন্য
একাধিক কর্মকর্তা ছিলেন, যেমন ‘আমিন’ এবং ‘কার্দার’, যারা ভূমি রাজস্ব সংগ্রহ
করতেন। সামরিক দিক থেকেও একটি শক্তিশালী কাঠামো ছিল, যেখানে ‘মীর বাকী এবং
‘কোটওয়াল’ দায়িত্ব পালন করতেন। মুসলিম প্রশাসন শৃঙ্খলাপূর্ণ বিচার
ব্যবস্থা, কর সংগ্রহ এবং সামরিক বাহিনীর দক্ষতায় নজর দেয়, যা রাজ্য
পরিচালনায় একটি নির্দিষ্ট সুশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রশাসনিক
কাঠামো ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে স্থিতিশীলতা এবং
শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক ছিল।
মুসলিম শাসনের সাংস্কৃতিক প্রভাব
মুসলিম শাসনের সময় ভারতবর্ষে গভীর সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যা
আজও বিদ্যমান। মুসলিম শাসকরা শিল্প, স্থাপত্য, ভাষা, এবং সংগীতের ক্ষেত্রে
অসাধারণ অবদান রাখেন। স্থাপত্যে, তাজমহল, হুমায়ূনের সমাধি, এবং কুতুব মিনার
প্রভৃতি মুঘল স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ। তারা পারস্য, তুর্কি, এবং স্থানীয়
শিল্পশৈলীর মিশ্রণে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। উর্দু ভাষার বিকাশ মুসলিম
শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা হিন্দি এবং ফারসি ভাষার মিশ্রণ থেকে উদ্ভূত
হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে, কবি এবং লেখকরা ইসলামিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে
অবদান রাখেন, যার মধ্যে মির্জা গালিব ও কবির অন্যতম। সংগীতের ক্ষেত্রে,
কাওয়ালি এবং সুফি সংগীতের প্রসার ঘটে, যা ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতধারায়
নতুন মাত্রা যোগ করে। মুসলিম শাসনের প্রভাব সামাজিক আচরণ ও আচার-অনুষ্ঠানেও
দেখা যায়, যা হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়। পোশাক, খাদ্যাভ্যাস,
এবং প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন দিকেও মুসলিম শাসনের সাংস্কৃতিক প্রভাব
সুস্পষ্ট। এই প্রভাবগুলি ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যকে
সমৃদ্ধ করেছে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন সৃষ্টি
করেছে।
মুসলিম শাসনের সামরিক কৌশল
মুসলিম শাসনের সময় সামরিক কৌশল ছিল শক্তিশালী এবং সুবিন্যস্ত, যা তাদের
শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল। তারা উন্নত অস্ত্রশস্ত্র, যেমন
তলোয়ার, ঢাল, তীর-ধনুক, এবং কামানের ব্যবহার করে যুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তার
করত। বিশেষ করে কামানের ব্যবহারে তারা সামরিক শক্তিতে বিপ্লব ঘটায়, যা
বিশেষত শহর এবং দুর্গ দখলে কার্যকর ছিল। মুসলিম শাসকরা একটি প্রশিক্ষিত এবং
শৃঙ্খলাবদ্ধ সেনাবাহিনী গঠন করতেন, যেখানে পদাতিক, অশ্বারোহী, এবং সিপাহীদের
মধ্যে নির্দিষ্ট ভূমিকা নির্ধারিত ছিল। তাদের সেনাবাহিনীতে ঘোড়সওয়ার বাহিনী
এবং হাতির ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল, যা তাদের দ্রুতগামী এবং
ভয়ঙ্কর প্রতিরক্ষা কৌশলে পরিণত করেছিল। এছাড়াও, তারা গুপ্তচরবৃত্তি এবং
তথ্য সংগ্রহে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে সঠিক
সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হত। মুসলিম শাসকরা সামরিক প্রশাসনে দক্ষতা বজায় রাখার
জন্য বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নিযুক্ত করতেন, যেমন *মীর বাকী*
এবং *খান-ই-খানা*, যারা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এই সামরিক
কৌশল এবং কাঠামো মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, বিস্তার এবং স্থিতিশীলতা
বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বিখ্যাত মুসলিম শাসকদের কার্যক্রম
বিখ্যাত মুসলিম শাসকরা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ভারতবর্ষে গভীর প্রভাব
ফেলেছেন। দিল্লি সালতানাতের শাসক ইলতুতমিশ প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্থিতিশীলতা
বজায় রেখে সালতানাতকে সুসংহত করেন। এরপর আলাউদ্দিন খলজি মুদ্রাস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয় লাভ করে মুঘল
সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। আকবর মহান উদার রাজনীতির জন্য খ্যাত, যিনি
দ্বীন-ই-ইলাহি নামে একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং ধর্মীয়
সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন। শাহজাহান তার রাজত্বকালে তাজমহল নির্মাণ করেন, যা
বিশ্বমানবতার এক অসামান্য স্থাপত্য নিদর্শন। আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মীয়ভাবে
কঠোর এবং শাস্ত্রানুযায়ী জীবনযাপনকারী শাসক, যিনি সাম্রাজ্যের বিস্তারে
ভূমিকা রাখেন। এছাড়া শেরশাহ সুরি রাস্তা নির্মাণ ও ডাক ব্যবস্থা প্রবর্তনের
মাধ্যমে প্রশাসনিক সংস্কারে বিশেষ অবদান রাখেন। হায়দার আলী এবং তার পুত্র
টিপু সুলতান ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজেদের সামরিক দক্ষতা
ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রমাণ করেন। এই শাসকরা তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে
ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে অমূল্য অবদান রেখেছেন এবং তাদের সময়কালকে
বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।
মুসলিম শাসনের পতন এবং পরে বাংলার অবস্থা
মুসলিম শাসনের পতন মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এবং ইউরোপীয় শক্তির
উত্থানের সাথে সম্পৃক্ত। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হতে
থাকে, এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও শাসকদের ক্ষমতার লড়াই
সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে। এ সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
বাণিজ্যের আড়ালে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব
সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই
পরাজয় বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত
করে।
মুসলিম শাসনের পতনের পর বাংলায় ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন আসে।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বাংলায় জমিদারি প্রথা প্রবর্তিত হয়, যা কৃষকদের জীবনে
ব্যাপক দুর্ভোগ বয়ে আনে। অর্থনৈতিক শোষণ, উচ্চ কর এবং কৃষি পণ্যের নিম্ন
মূল্য বাংলার সাধারণ জনগণের জীবনে দুর্দশা ডেকে আনে। ব্রিটিশরা বাংলার শিল্প
ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে, যা স্থানীয় কুটির শিল্পের পতন ঘটায়। এছাড়াও,
ব্রিটিশ শাসনের সময় বাংলায় শিক্ষার প্রসার এবং আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার সূচনা
হয়, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে
ব্রিটিশ শাসনের অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক অবিচার বাংলার জনগণের মধ্যে গভীর
হতাশা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন কে? সে সম্পর্কে সুন্দর ও মার্জিতভাবে
একটি উপসংহার
আমরা আলোচনা করে এসেছি বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন ইখতিয়ার উদ্দিন
মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। ১২০৪ সালে গৌড় অভিযান পরিচালনা করে তিনি লক্ষণ
সেনের শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলা জয় করেন। বখতিয়ার খলজির এই বিজয় বাংলায়
মুসলিম শাসনের পথপ্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়। তার শাসনকালে বাংলা
অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ও মুসলিম স্থাপত্যের বিকাশ শুরু হয়। বখতিয়ার খলজি
শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে প্রাদেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলার
প্রশাসনিক কাঠামোতে মুসলিম রীতিনীতি প্রবর্তন করেন।
তার শাসনামল বাংলার জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করে। তিনি শিক্ষা ও
সংস্কৃতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, বিশেষ করে নালন্দা
বিশ্ববিদ্যালয় ও বিক্রমশীলা মহাবিহার আক্রমণের পর বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্রগুলো
ধ্বংস করেন এবং মুসলিম শিক্ষার প্রসার ঘটান। বখতিয়ার খলজির শাসনের সময়ে
বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে, যা পরবর্তীকালে বাংলার সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। বাংলায় মুসলিম শাসনের
সূচনা শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, এটি একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক
পরিবর্তনও নিয়ে আসে, যা বাংলার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে।
মুসলিম শাসনের এই সূচনা বাংলার সমাজে একটি বহুমুখী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়
পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা আজও বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিরাজমান।
বখতিয়ার খলজির শাসনকাল বাংলায় মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে, যা
পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হয় এবং বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ
প্রভাব ফেলে। তার বিজয় এবং শাসন বাংলার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা
করে, যা বাংলার ভবিষ্যত রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা নির্ধারণে
সহায়ক হয়।
আমরা আশা করছি আপনি আমাদের পোস্টটি সম্পূর্ণ পড়েছেন এবং বাংলায় মুসলিম
শাসনের সূচনা করেন কে? সে সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান অর্জন
করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের মূল লক্ষ্য হলো আপনাদের মাঝে সঠিক তথ্যগুলোকে উপস্থাপন করা এবং পৌঁছে
দেওয়া এবং এতে আপনাদের সহযোগীতা আমরা একান্তভাবে কাম্য করছি। লেখাটি আপনাদের
পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আরো অন্যান্যদের নিকট শেয়ার করে তাদেরও এই
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানার সুযোগ করে দিন।